চীনা ঋণ নিয়ে ছিল ঢাকা-দিল্লির মধ্যে নীরব কূটনীতি। চিঠি চালাচালির মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। এবার নীরব নয়, প্রকাশ্যে এসেছে। এখন পৌঁছে গেছে একদম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এই সপ্তাহের গোড়ার দিকে মিউনিখে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক বাহাসে জড়ান।
দিল্লি আগাগোড়াই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করে ঢাকা যেভাবে চীনের কাছ থেকে সহায়তা নিচ্ছে তাতে ঋণের ফাঁদে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমনটা পড়েছে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। দিল্লি কখনো পাকিস্তানকে এর সঙ্গে যুক্ত করেনি।
বাংলাদেশ বলছে তার অবকাঠামো গড়া দরকার। এর জন্য প্রয়োজন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। কে যোগাবে টাকা? কেউ তো টাকা নিয়ে আসেনি। বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে এসেছে চীন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন এ ধরনের কথাই বলেছেন মিউনিখ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে।
এক প্যানেল আলোচনায় চীনা ঋণ নিয়ে বিতর্কের সূচনা করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। যদিও তিনি এই প্যানেলে আলোচক ছিলেন না। তিনি এই আলোচনায় একজন সম্মানিত দর্শক ছিলেন মাত্র। ফ্রান্স, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচক ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
আলোচনার এক পর্যায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানতে চান উন্নয়ন প্রকল্পে কোয়াড জোটভুক্ত দেশগুলো চীনের মতো আর্থিক সহায়তা নিয়ে আসতে প্রস্তুত কিনা? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এস জয়শঙ্কর ভারতের মনোভাব তুলে ধরেন। বলেন, কি সব প্রকল্পে ঋণ আসছে।
বিমানবন্দর আছে, বিমান উড়ে না। সমুদ্র বন্দরের বেলায়ও একই কথা। বন্দরে কোনো জাহাজের দেখা নেই। এসব প্রকল্প অযৌক্তিক। এতে করে ঋণের বোঝা বাড়ছে। দেশগুলো দেউলিয়া হচ্ছে। ফতুর হয়ে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা কি দেখতে পাই। চীনের অর্থায়নে নির্মিত হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দরটি শেষ পর্যন্ত একটি চীনা কোম্পানির কাছে ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি। তারা ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছিল।
ড. মোমেন আবারো ফ্লোর নিয়ে বলেন- ভারত, জাপানও আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করেছে। লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ভারত আমাদের ঋণ সহায়তা দিয়েছে। এখন ঋণের পরিমাণ কমে গেছে। এর মধ্যে চীন এসেছে টাকার বস্তা নিয়ে।
তারা শুধু সাশ্রয়ী নয়, আগ্রাসীও বটে। অন্যরা টাকা দেবে না। আমরা কি করবো? তাই চীনের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি। কারণ আমাদের অবকাঠামো গড়তে বিপুল পরিমাণ টাকার প্রয়োজন। আমাদের জনগণও অবকাঠামোগত উন্নয়ন চায়।
মিউনিখ সম্মেলনে মোমেনের বক্তব্যের পর হালকা রসিকতাও হয়েছে। প্যানেল আলোচনাকালে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জিমি শাহীন। ড. মোমেন তার কাছে এক পর্যায়ে জানতে চান যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে আরও আকর্ষণীয় অর্থায়ন প্রস্তাব নিয়ে আসতে চায়? চটজলদি জবাব দেন সিনেটর। বলেন, মি. মোমেন আমি ভেবেছিলাম প্রশ্নটি আপনি ভারতীয় মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে করেছেন।
এস জয়শঙ্কর হাসলেন। বললেন, আমার কেন যেন মনে হয় মোমেন ভেবেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশি টাকা আছে। যাই হোক কোন দেশ কার কাছ থেকে ঋণ নেবে তা ঐ দেশের স্বার্থেই বিবেচনা করা উচিত।
চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেন জয়শঙ্কর। বলেন, দু’দেশের সম্পর্ক কঠিন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২০-এর এপ্রিল থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘন করে চলেছে চীন। সীমান্ত সমস্যার কারণেই দু’দেশের সম্পর্কে এই টানাপড়েন।
চীনের ঋণ নিয়ে কিছুকাল যাবৎ ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে সন্দেহ আর অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। ভারত অস্বস্তি প্রকাশ করলেও বিশ্লেষকরা বলছেন এমন তো নয় যে, চীন থেকে ভারত ঋণ সুবিধা নেয়নি? সমালোচকরা বলছেন, ইন্দো প্যাসিফিকের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখনই প্রশ্ন উঠে তখনই এই অঞ্চলে চীনের সরব উপস্থিতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যায়।
‘চীনের ঋণের ফাঁদ’ এখন বিশ্ব কূটনীতিতে বেশ অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা জুড়েই চীনের আগ্রাসী ঋণনীতি। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ কি চীনা ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। পাকিস্তানের পর দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিনিয়োগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্রহীতা হচ্ছে বাংলাদেশ।
রেফারেন্স হিসেবে পাকিস্তানের চায়না ইকোনমিক করিডোর, গোয়াদার গভীর সমুদ্রবন্দর ও কলম্বোর হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও কলম্বোর চাইনিজ সিটি, মালদ্বীপের আন্তঃদ্বীপ যোগাযোগ সেতু, মিয়ানমারের কিয়া কফ্যু গভীর সমুদ্রবন্দর ও তেল গ্যাস পাইপ লাইনের কথাই বলা হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে ১ বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন নিয়ে ভারত প্রকাশ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজেও চীনের অর্থায়নে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে প্রতিবেশী দেশটি।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে ২৭টি প্রকল্পে ২৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ৪০০ মিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ যা নির্মিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে।
প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেল সংযোগ যেখানে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে চীনের একটি ব্যাংক।
এ ছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিতব্য ১ হাজার ৩০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চীন বিনিয়োগ করেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুতের আধুনিকায়নেও বিনিয়োগ করেছে চীন।
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে দেশটি। অতিসম্প্রতি চীন চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের কাছে একটি উপশহর গড়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
দিল্লি এসব মেগা প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে। ঢাকা সব সময় বলেছে, তারা জাতীয় স্বার্থেই ঋণ নিচ্ছে। এ নিয়ে ভারত বিভিন্ন ফোরামেও তাদের অস্বস্তির কথা প্রকাশ করেছে। মিউনিখে যা ঘটলো তা আর গোপন নেই।
ভারতের এই অস্বস্তি কাটাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন আজ ভারত যাচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে চীনা ঋণ এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলার সঙ্গে আলোচনা করবেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অন্য এক ইস্যুতে ভারত সফর করেছেন। মতবিনিময় করেছেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বর্তমানে দিল্লি রয়েছেন। যদিও বলা হয়েছে চিকিৎসার জন্য তিনি সেখানে গেছেন।
ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ হবে- এমনটাই বলাবলি রয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকও ক’দিন আগে দিল্লি সফর করেন। র্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পটভূমিতে এসব সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।