একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান পরিচালনায়ও ন্যূনতম পাঁচজন শিক্ষকের প্রয়োজন পড়ে। সেখানে একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে মাত্র ছয়জন শিক্ষক দিয়ে। শিক্ষক সংখ্যার নাজুক এ চিত্র বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয়টি প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য পূর্ণকালীন শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ছয়জন। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রোগ্রাম চলছে শিক্ষক ছাড়াই।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নীতিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রোগ্রামে কমপক্ষে চারজন স্থায়ী বা পূর্ণকালীন শিক্ষক থাকতে হবে। এর মধ্যে একজন কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার হতে হবে।
যদিও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রোগ্রামেই সেটি অনুসরণ করা হচ্ছে না।
জানা যায়, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (এইচটিএম)।
২০২০ সালের মার্চে প্রোগ্রামটির অনুমোদন দেয় ইউজিসি। এরপর দুটি ব্যাচে শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
যদিও প্রোগ্রামটির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পূর্ণকালীন কিংবা খণ্ডকালীন কোনো শিক্ষকই নেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বেশ শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা।
শুধু এইচটিএম নয়; বিশ্ববিদ্যালয়টির সবক’টি বিভাগেই শিক্ষক সংখ্যার চিত্র খুবই নাজুক। খুবই স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
আবার এসব শিক্ষকের বেশির ভাগই খণ্ডকালীন। বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয়টি প্রোগ্রামের বিপরীতে সব মিলিয়ে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৭ জন। এর মধ্যে পূর্ণকালীন শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ছয়জন।
যদিও একেকটি প্রোগ্রামেই কমপক্ষে চারজন করে পূর্ণকালীন শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক।
বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) ও মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন—এ দুটি প্রোগ্রাম মিলে শিক্ষক রয়েছেন তিনজন। এর মধ্যে মাত্র একজন পূর্ণকালীন।
বাকি দুজন খণ্ডকালীন ভিত্তিতে শিক্ষকতা করছেন সেখানে। ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন চারজন। এর মধ্যে দুজন খণ্ডকালীন ও বাকি দুজন পূর্ণকালীন।
গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র তিনজন। এর মধ্যে দুজন পূর্ণকালীন ও একজন খণ্ডকালীন। আর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে একজন পূর্ণকালীন ও ছয়জন খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন।
তবে শিক্ষক সংখ্যার তথ্য সঠিক নয় দাবি করে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফ ইমাম আলী বলেন, আমাদের এখানে পূর্ণকালীন শিক্ষকের পাশাপাশি খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছে। তবে করোনার কারণে আমাদের পূর্ণকালীন শিক্ষকের সংখ্যা কমে গেছে।
তবে সে সময়ই আমরা খণ্ডকালীন শিক্ষক বাড়িয়েছি। আমাদের এখানে ১২ জন পূর্ণকালীন আর ১৪ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেব চট্টগ্রামের শিক্ষকরা কাজ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টি অনগ্রসর এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে। এখানে চট্টগ্রামের বাইরে থেকে শিক্ষক নেয়া কঠিন। তবে ৬ জন শিক্ষক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে এ কথা মোটেও সত্য নয়।
এদিকে শিক্ষক সংকটসহ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা বিষয়ে ইউজিসিতে একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা।
গত মাসে কমিশনে পাঠানো একটি অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘আমরা অনেক আশা-ভরসা নিয়ে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার জন্য ভর্তি হই। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার এতই নাজুক পরিস্থিতি যে পড়ালেখার কোনো পরিবেশ বিদ্যমান নেই। আমরা শিক্ষাজীবন নিয়ে চরম সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি।’
শিক্ষক সংকট বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ইংরেজি বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে দুজন প্রভাষক দিয়ে। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই নিম্নমানের। কোনো সিনিয়র শিক্ষক নেই।
বিবিএ, এমবিএ ও এইচটিএম—এ তিনটি প্রোগ্রাম চলছে একজন প্রভাষক দিয়ে। কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চলছে একজন মাত্র প্রভাষক দিয়ে। তার শিক্ষকতার যোগ্যতাও খুব নিম্নমানের।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ট্রাস্টের চেয়ারম্যানকে জানিয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলে কমিশনের কাছে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছ থেকে শিক্ষক তালিকা তলব করে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি।
রেজিস্ট্রারকে পাঠানো কমিশনের চিঠিতে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামভিত্তিক নিয়োজিত শিক্ষকদের তালিকা (প্রতি পাতায় স্বাক্ষর সংবলিত জীবন-বৃত্তান্তসহ) আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিশনে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
যদিও নির্ধারিত সময় পার হলেও এখনো কমিশনকে এ-সংক্রান্ত তালিকা পাঠায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
এদিকে পূর্ণকালীন ও খণ্ডকালীন শিক্ষক অনুপাতেও আইন মানা হচ্ছে না বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ৩৫ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ বা প্রোগ্রামের খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা সংশ্লিষ্ট কোর্সের পূর্ণকালীন শিক্ষক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হইবে না।
যদিও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা পূর্ণকালীন শিক্ষক সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কমিশনে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। সে আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছ থেকে কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে।