দেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ফসলেও ক্ষতির আশঙ্কা

google news

বছরের শুরু থেকেই আবহাওয়ার আচরণকেই অস্বাভাবিক মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দেশে বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টিপাত হলেও অধিকাংশ অঞ্চলে বর্তমানে কার্যত খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সামনের দিনগুলোতেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টানা বৃষ্টি কিংবা টানা খরার পরিস্থিতির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের কৃষিখাতেও এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের কিছু এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হতে পারে, আবার কিছু এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি তাপমাত্রা কমতে পারে।

কিন্তু বৃষ্টিপাত যেমনই হোক, দেশের কৃষিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। ফলে দেশে তৈরি হতে পারে ফসলহানির মতো পরিস্থিতিও।

উত্তরাঞ্চলের খরা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, খরার কারণে বোরো ধানের মৌসুমে অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করতে হলে সেটি পরিবেশেও প্রভাব ফেলবে।

টানা বৃষ্টি বা খরার আশঙ্কা

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ জানান, এ বছরের শুরু থেকেই দেশের আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করছে এবং বর্তমানে এর বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণের কাজ চলছে।

এখন যে বৃষ্টি হওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না, আবার বিস্ময়কর হলেও কোথাও কোথাও মাঝেমাঝে শীতের আমেজ টের পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের রবিবারের (৩ এপ্রিল) বিভাগীয় পূর্বভাস অনুসারে, সিলেট ও রংপুর বিভাগে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২২ ও ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা নামতে পারে।

অথচ অন্যান্য কোনো বিভাগেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামার পূর্বাভাস নেই।

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েকদিন ধরে রংপুরে শীত শীত অনভূতি হচ্ছে। আবার এখন দেশজুড়ে শুষ্কতা বিরাজ করছে এবং এ সময়ে স্বাভাবিকের মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে না।

যদিও ফেব্রুয়ারি মাসে এখনকার চাইতে কম বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও তখন স্বাভাবিকের চেয়ে ৫০% বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে কোথাও কোথাও কালবৈশাখীর মতো ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি হয়েছে। অথচ ওই সময়ে এমন ঝড় হওয়ার কথা না।

অন্যদিকে, শিলার আকারও কিছুটা বড় রকমের ছিল। ওদিকে এখন সারা দেশে কিন্তু প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না।

আবার হয়তো ৭-৮ দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাত হতে দেখা যাবে। আবার হয়তো কিছুদিন কোনো বৃষ্টিপাতই হবে না।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, আবাহাওয়ার এ অপ্রত্যাশিত আচরণ নিয়ে রবিবার ঢাকায় আবহাওয়া দপ্তরে একটি পর্যালোচনা বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

আবহাওয়াবিদদের দাবি, ভারত মহাসাগরের অস্বাভাবিক অবস্থার প্রভাবেই এমনটি হচ্ছে। এর প্রভাব কতটা কেমন হবে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষকরা বিশ্লেষণ করছেন। এসব বিশ্লেষণও বৈঠকে উঠে আসতে পারে।

দাবদাহের সম্ভাবনা

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ভাষ্যমতে, কোনো জায়গার দৈনিক গড় তাপমাত্রা আগের ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গেলে এবং তা টানা ৫ দিন অব্যাহত থাকলে তাকে দাবদাহ বলা হয়।

তবে একেক দেশে দাবদাহের পরিমাপক বিভিন্ন রকমের।

বাংলাদেশের আবহাওয়ার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে তাকে মৃদু দাবদাহ, ৩৮-৪০ ডিগ্রি হলে তাকে মধ্যম মাত্রার দাবদাহ, ৪০-৪২ ডিগ্রি হলে সেটিকে তীব্র বা মারাত্মক দাবদাহ এবং ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে তাকে অতি তীব্র দাবদাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সে হিসেবে বাংলাদেশে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে দাবদাহ শুরু হয়। তবে দাবদাহের পুরো বিষয়টি মানবদেহের খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

বিশ্লেষকদের দাবি, খরা পরিস্থিতি কোনো কারণে প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশে দাবদাহ দেখা যেতে পারে।

গত বছর এক পর্যালোচনায় আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়,মার্চের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্য তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আবহাওহয়াকে তিনটি সময়কালে ভাগ করা হয়েছে- অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঠাণ্ডা ও শুষ্ক, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত গ্রীস্মকাল এবং জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময়।

আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ কৃষিক্ষেত্রে যেমন প্রভাব ফেলবে

অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহানের মতে, দাবদাহ হলে তা কৃষি উৎপাদনে- পরাগায়ন থেকে শুরু করে একটি ফসলের প্রতিটি ধাপে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

তিনি বলেন, “আবহাওয়া এমন উদ্ভট হয়ে উঠলে কৃষিক্ষেত্রে এর প্রভাব এড়ানো কঠিন। এখন যে অনাবৃষ্টি তারও প্রভাব পড়বে। আবার বিকল্প ব্যবস্থা নিতে গেলেও প্রভাব পড়ে।

যেমন- খরার কারণে বোরো ধানের চাষে অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করতে গেলে পরিবেশে প্রভাব পড়বে।”

চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, গত কয়েক বছর ধরেই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আবহাওয়ার উদ্ভট আচরণ ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যেসব দেশ ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশও তার মধ্যে অন্যতম।

এর ফলে অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে।

দরিদ্র দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এ চরম আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি।

মতামত দিন