যুদ্ধের কারণে ইউক্রেইনের শরণার্থী সংকটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
বুধবার (২৫ মে) ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের জন্য এখন পর্যন্ত দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার কথা জানানো হলেও ইউক্রেইন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপট নতুন ভাবনা তৈরি করেছে বলে তুলে ধরেন তিনি।
পাঁচ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসা ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো বলেন, “এখন পর্যন্ত দাতাদের কাছ থেকে আমরা সমর্থন পেয়েছি। তবে এখন আমি কিছুটা চিন্তিত। প্রথমত, ভাসানচরের কারণে প্রয়োজনটা বেশি। আর ইউক্রেইন ও আফগানিস্তানের মত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সংকটও আমরা মোকাবেলা করছি।”
সফরকালে তিনি কক্সবাজারের পাশাপাশি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেন।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারে টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে আসছে ইউএনএইচসিআর।
কক্সবাজারের জনঘনত্বের কথা বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে অবকাঠামো তৈরি করেছে সরকার। এরই মধ্যে সেখানে নেওয়া হয়েছে ২৮ হাজারের মত মিয়ানমারের নাগরিককে।
প্রতি বছর ঘোষিত জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় দাতা দেশ ও সংস্থার অনুদান নিয়ে থাকে ইউএনএইচসিআর। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচটি জেআরপিতে অর্থায়ন পরিকল্পনার মধ্যে চার বছর ৭০ থেকে ৭৫% পর্যন্ত অনুদান পাওয়া গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালে অর্থায়ন হয়েছিল ৫৯.৫০%।
২০২১ সালে জেআরপির অর্থায়ন পরিকল্পনার ৯৪ কোটি ৩১ লাখ ডলারের মধ্যে অনুদান পাওয়া গিয়েছিল ৬৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, যা পরিকল্পনার ৭১.৯০%।
২০২২ সালের জন্য জেআরপির অর্থায়ন পরিকল্পনা করা হয়েছে ৮৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ২৫ মে পর্যন্ত ১১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার অর্থায়ন হয়েছে, যা মোট অংকের ১৩.৩০%।
অর্থায়নের এমন প্রেক্ষাপট নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, “বিগত বছরগুলোতে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের পুরোপুরি অর্থায়ন হয়নি তা ঠিক।
তবে অর্থায়নের প্রক্রিয়া বিবেচনায় সেটাকে সন্তোষজনক। এই পরিকল্পনায় পুরোপুরি অর্থায়ন হয়নি ঠিক, তবে এটা কোনো কোনো বছর ৭৫% পর্যন্ত হয়েছে। আপনি যদি বিবেচনায় নেন, কীভাবে এই তহবিল আসে তাহলে বুঝবেন এটা অতটা খারাপ ফলাফল নয়।”
নতুন সংকট সামনে এলেও রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন চালু রাখতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “যাতে বিশ্বের মানুষ জানে, এই সংকট ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, নানাবিধ সংকটে বেশি দৃষ্টি ও সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে যাওয়ার কারণে- বিশেষ ইউক্রেইন সংকটের ফলে- কিছু সংকট এক কোণায় পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।”
ইউক্রেইন সংকটের ধাক্কা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও লাগার কথা তুলে ধরে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন ইউএনএইচসিআর প্রধান।
অর্থায়ন বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “কখনও বলব না, এটা অসম্ভব। তবে সত্যি কথা বলতে, এটা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় কঠিন হবে।
এটা বাংলাদেশ সরকার, ইউএনএইচসিআর ও দাতারাও জানে। আর সেই কারণেই তার এ সফর বলে উল্লেখ করেন তিনি।”
মানবিক দিক বিবেচনায় অর্থায়নে “কাটছাঁট” দাতাগোষ্ঠী করবে না বলে আশা প্রকাশ করে ফিলিপ্পো বলেন, “কারণ এখানে জীবনের প্রশ্ন, জীবিকার প্রশ্ন।
আমি আপনার সঙ্গে একমত, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তবে, আমরা ছেড়ে দিব না, আমি ছেড়ে দিব না।”
ভাসানচরে অর্থায়ন
ভাসানচরের জন্য অর্থায়নের বিষয়ে দাতা দেশগুলোর মনোভাবের বিষয়ে এক প্রশ্নে ফিলিপ্পো বলেন, “হ্যাঁ, তারা বুঝতে পারে এরা কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদেরই অংশ।
তাদেরও একই রকমের সহায়তা দরকার এবং এটা করা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, এর জন্য তাদের বুঝতে হবে কার্যক্রমটা কতটা টেকসই। তারা এমন জায়গায় টাকা ঢালবে না, যেটা টেকসই নয়, এটা সব দাতার ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক।
এ কারণে আমি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করব, আলোচনা চালিয়ে যাব- কীভাবে আমরা এটাকে টেকসই করতে পারি।”
ভাসানচরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা সরকারের সঙ্গে এটা নিয়ে কাজ করব।
যাতে এটা দাতাদের জন্য অর্থবহ করা যায়।
অবকাঠামো, স্যানিটেশন প্রভৃতি ছোটখাটো কোনো কাজ নয়। এটাতে দীর্ঘ সময় লাগবে।
আমি এখানে রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে স্বদিচ্ছার কথা শুনেছি। সবাই বলেছে, আমাদের ভালো যুক্তি দেন, যাতে রাজধানীতে তা পাঠাতে পারি।
কারণ, ফান্ডতো রাজধানীতে, দূতাবাসে নয়।”
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকারের অবস্থানের সঙ্গেও একমত প্রকাশ করে ইউএনএইচসিআর প্রধান বলেন, “সংকটের সমাধান মিয়ানমারের কাছেই।
রাখাইন রাজ্যে ত্রি-পক্ষীয় চুক্তির আওতায় বিভিন্ন স্থানীয় প্রকল্পে কাজ করছে ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপি।
এক্ষেত্রে আরও বেশি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও স্থায়ীভাবে যাওয়ার পথ তৈরি হয়। যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে আলাপ করেছি, পরিস্থিতি ঠিক থাকলে তারা ফেরার ইচ্ছাই প্রকাশ করেছে।
বিশ্ববাসীর উচিত তাদের দুর্দশার গোঁড়ার কারণ তুলে ধরা এবং তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করা।”
রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের বর্তমানের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা চালিয়ে যেতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ফিলিপ্পো।
রোহিঙ্গারা যে দ্রুতই যাচ্ছে না, সে বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা এমন বিষয়, যা আগামীকাল হয়ে যাবে না। এতে সময় ও ধৈর্য লাগবে, বিনিয়োগও প্রয়োজন।
চলুন আশা করি, একটা প্রক্রিয়া শুরু হোক, যাতে কিছু লোক অন্তত স্বেচ্ছায় ফিরে গেছে।
তবে বাস্তবতা হল আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।”
২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।