পুরো নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস। অ্যাকুরিয়ামে শোভাবর্ধনকারী হিসেবে রাখা হয় বিদেশি প্রজাতির এ মাছটিকে।
বাংলাদেশের জলাশয়ে গত ১০ বছর ধরেই পাওয়া যাচ্ছে সাকার ফিশ। অ্যাকুয়ারিয়ামের শোভাবর্ধক ও আবর্জনাভুক এই ‘অ্যাকুরিয়াম ফিশ’টি ছড়িয়ে পড়েছে নদী ও পুকুরে।
হরহামেশাই বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ডোবা-নালাসহ বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা মিলছে মাছটির।
দ্রুত বংশবিস্তারের মাধ্যমে দখল করছে অন্য মাছের আবাসস্থল সাকার ফিশ। মাছটি রাক্ষুসে প্রজাতির না হলেও প্রচুর পরিমাণে খাবার ভক্ষণ করে।
উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের ডিম ও নিচের শ্যাওলা-আবর্জনা খেয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে খাদ্যশৃঙ্খলে। খাবার হিসেবে অত্যন্ত নিম্নমানের এই মাছ দ্রুত দখল নিচ্ছে জলাশয়ের।
এতে দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্যের জোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না বিলুপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের।
সব মিলিয়ে এটি এখন দেশি মাছের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ কারণে এবার মাছটি নিষিদ্ধে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে আইনগতভাবে এই মাছটি আমদানি, উৎপাদন, বিপণনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ২০০৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পিরানহা ও ২০১৪ সালের ১০ জুন আফ্রিকান মাগুর মাছ নিষিদ্ধ করা হয়। এরই ধারবাহিকতায় নিষিদ্ধ হচ্ছে আবর্জনাভুক সাকার ফিশ।
নাম আর পরিচয়
১৬-১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা এই মাছের নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ, অথবা কমন প্লেকো। ক্যাটফিশ মানে শিং-মাগুর জাতের এই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস।
মুখের আকারে জলহস্তীর সাথে মিল থাকায় এই নামকরণ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, এই মাছের অনেকগুলো প্রজাতি আছে, এর মধ্যে যেটি বাংলাদেশে পাওয়া যায়, সেটি আকারে বেশি বড় নয়।
পৃথিবীর কোন দেশেই এই মাছ খাওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ নয়, বরং এটি অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ হিসেবেই পরিচিত।
কিভাবে এলো বাংলাদেশে?
মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত নব্বইয়ের দশকে অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ হিসেবে সাকার ফিশ আমদানি করা হয় বাংলাদেশে।
দেশে যে ধরণের সাকার ফিশ দেখা যায়, সেটা মূলত ব্রাজিল থেকে আনা হয়েছিল। এরপর স্থানীয় অ্যাকোয়ারিয়াম ব্যবসায়ীদের হাত ধরে দেশে এই মাছের চাষ প্রাথমিকভাবে শুরু হয়।
আতংকের নাম ‘সাকার ফিশ’
দেশের জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়া দক্ষিণ অ্যামেরিকার ‘সাকারমাউথ ক্যাট ফিশ’ বা ‘সাকার মাছ’ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতেও পাওয়া গেছে। যা উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, সাকার ফিশ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের মিঠা পানির মাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। আর হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক ডিম উৎপাদন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
তাই তারা এই মাছ নির্মূলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।
তাদের মতে, সাকার মাছ অন্য দেশি মাছের খাবার খেয়ে ফেলে এবং অবাসস্থল দখল করে। বাংলাদেশের মানুষ এ মাছ না খাওয়ায় তারা দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে এবং যেকোনো পরিবেশে টিকে থাকে।
হালদা নদীর জেলে কামাল সওদাগর জানান, গত বছর থেকে তারা জাল ফেললে সাকার মাছ পাচ্ছেন। নদীর কয়েকটি এলাকায় এই মাছের উপস্থিতি খুব বেশি।
এভাবে চলতে থাকলে মাছের প্রাকৃতিক ডিম কমতে থাকবে বলে মনে করেন তিনি। বিষয়টি জেলেরা মৎস্য অধিদফতরকে জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ জানান, হালদা নদীতে আট ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের সাকার মাছও পাওয়া গেছে। এটা ১৮-২০ ইঞ্চিও হয়। আমদের ধারণা, আরো বড় সাকার মাছ ওই নদীতে আছে।
মৎস্যবিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ বছর ধরেই বাংলাদেশের জলাশয়ে সাকার মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এই অ্যাকুরিয়াম ফিশটি গুলশান লেক থেকে ছড়িয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এখন এটা নদী ও পুকুরে ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি সাকার মাছ পাওয়া যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে।
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে জেলেরা জাল ফেললে সাকার মাছে জাল ভরে ওঠে। অন্য কোনো মাছ পাওয়া যায় না।” তারা দূষিত পানিতেও টিকে থেকে বংশবৃদ্ধি করে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে যে দেশি মাছ পাওয়া যেত তা এখন আর পাওয়া যায় না বলে জানান তিনি।
সাকার মাছ নিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কাজ করছেন।
জলাশয়ের মাছের কী ক্ষতি করে?
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের শিক্ষক হালিমা জাহান গনমাধ্যমকে বলেছেন, দেশীয় প্রজাতির মাছের ওপর সাকার ফিশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তিনি বলছেন, “এটি জলাশয়ের জলজ পোকামাকড়, শ্যাওলা এসবের সঙ্গে সঙ্গে অন্য ছোট ছোট মাছ বা মাছের পোনা খেয়ে ফেলে। ফলে চাষিদের সমস্যা হয়।”
আবার সাকার ফিশের পাখনা খুব ধারালো, দেখা যায় অন্য মাছের সঙ্গে লড়াই করার সময় সেগুলোর শরীরে সহজেই ক্ষত তৈরি হয়।
এই ক্ষত দ্রুত পচন ধরিয়ে দেয়, এবং ফল হয় অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। ফলে মাছের সংখ্যা অনেক কমে যায়।
মৎস্য আইন ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতি সাধন হয় এমন যে কোন বিদেশি মাছ চাষ দণ্ডনীয় অপরাধ।
তবে, মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, সাকার ফিশ শিকার করে না, বরং সে চুষে বা শুষে একসঙ্গে প্রচুর খাবার খায় এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।
তিনি বলেন, “যে কারণে যে কোন মুক্ত জলাশয়ে থাকা অন্য মাছের সঙ্গে আবাস এবং খাদ্যের যোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। তাতে অনেক সময়ই দেশীয় জাতের মাছ টিকে থাকতে পারে না।”
সেইটি একটি ক্ষতি, আর সে কারণে এই মাছের চাষে উৎসাহ দেয়া হয় না।
কারণ ড্রাম বা হাপায় করে যখন মাছ চাষ করা হয়, তার গায়ে অনেক সময় যে শ্যাওলা জমে সেটি সাকার ফিশ খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে পারে, তাতে মাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে না।
কিভাবে নিরাপদ থাকা যাবে?
সাকার ফিশের কারণে ইতোমধ্যে মিয়ানমার ও আরব আমিরাতের মৎস্য চাষিরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে বলে জানা যায়।
কিন্তু মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক মি. মাহমুদ বলেছেন, মিয়ানমারে যে জাতের সাকার ফিশ দেখা যায় সেটি আকারে অনেক বড়।
বাংলাদেশে যে জাতের সাকার ফিশ দেখা যায় সেটি খুব আকারের নয়।
কোন জলাশয়ে যদি সাকার ফিশ দেখা যায় তাহলে সেটি জাল দিয়ে ধরে তুলে ফেলার পরামর্শ দেন মি. মাহমুদ।
তবে এটি ক্যাটফিশ জাতের হওয়ায় জলাশয়ের একেবারে নিচের স্তরে থাকে, ফলে সরিয়ে ফেলার কাজটি খুবই কঠিন।
গবেষকেরা বলছেন, যেহেতু দেশীয় মৎস্য খাতে গত কয়েক দশকে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে, সে কারণে এ খাতে সুরক্ষা দেয়ার জন্য দেশীয় মাছের জন্য যা সহায়ক নয়, সে বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।