দেশে বর্তমানে তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ভাইরাসের বি ও সি ধরনে আক্রান্ত হতে বেশি দেখা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫.৫% মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং ০.৬% মানুষ হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বাহক।
সব মিলিয়ে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিসের বি ও সি ধরনে আক্রান্ত। তবে তাদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদী ইনফেকশনে নানাবিধ জটিল লিভার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, দেশে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই জানেন না যে তার শরীরে হেপাটাইটিস বি অথবা সি ধরনের অস্তিত্ব রয়েছে।
রবিবার (২৪ জুলাই ২০২২) দুপুরে ঢাকার একটি হোটেলে ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন ও হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের যৌথ আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।
হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস নীরব ঘাতক
ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসকে নীরব ঘাতক বলা হয়। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য লক্ষণ দেখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, “হেপাটাইটিস বি ও সি লিভার ক্যান্সারের প্রধানতম কারণ এবং বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান ১০টি কারণের অন্যতম হলো লিভার সিরোসিস। লিভার ক্যান্সার বিশ্বে এবং বাংলাদেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ।
এই দুই ভাইরাসজনিত লিভার রোগের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১.৮ মিলিয়ন মানুষ এবং প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ মৃত্যুবরণ করে।”
হেপাটাইটিস রোগের প্রতিরোধ
রোগেরটি প্রতিরোধ প্রসঙ্গে ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, “হেপাটাইটিস প্রতিরোধে সচেতনতা খুবই বড় বিষয়। আমাদের দেশের ৬০-৬৫% লোক গ্রামে বসবাস করেন।
হেপাটাইটিস কী, কীভাবে ছড়ায় বা এর চিকিৎসা কী.. এসব ব্যাপারে গ্রামের মানুষের কোনো ধারণা নেই। তাই তাদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা গবেষণায় দেখেছি রোহিঙ্গাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হেপাটাইটিস। এ হার প্রায় ১৮%-এর মতো। তাদের নিয়েও আমাদেরকে কাজ করতে হবে।”
চিকিৎসার চেয়ে যেকোনো রোগ প্রতিরোধ সবচেয়ে উত্তম
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, “চিকিৎসার চেয়ে যেকোনো রোগ প্রতিরোধ সবচেয়ে উত্তম।
হেপাটাইসিসের চিকিৎসায় সরকার শেখ রাসেল, বারডেম ও শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে কয়েক কোটি টাকা অর্থ দিয়েছে। ভাইরাসটিতে মায়ের থেকে শিশু সংক্রমিত হয়।
এটির জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যদি চিকিৎসা ও প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরও বলেন, “এসব কাজের জন্য অর্থের পাশাপাশি ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। দেশে যত ব্লাড ব্যাংক আছে, সেখানে বিপুল সংখ্যক রক্ত সঞ্চালন হয়, সেখানে কি পরিমাণে ভাইরাসটি শনাক্ত হয় সেটি করতে পারলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।”
পাঁচ রকমের হেপাটাইটিস ভাইরাস
লিভার বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল ডা. মো. রবিউল হোসেন বলেন, “আমরা জানি মোট পাঁচ রকমের হেপাটাইটিস ভাইরাস রয়েছে।
তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো বি এবং সি। বাকিগুলো এতোটা মারাত্মক নয়। চিকিৎসায় সেগুলো ভালো হয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে মোট ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সিতে আক্রান্ত।
এই ভাইরাস মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বিশেষ করে লিভারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই ভাইরাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে। এর আগে একে আমরা জন্ডিস হিসেবেই জানতাম।”
এ লিভার বিশেষজ্ঞ বলেন, “হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে সরকারের সবচেয়ে সফল উদ্যোগ হলো টিকাদান। হেপাটাইটিসের টিকার মাধ্যমে সরকার এই ভাইরাস কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন।”
জেনে নিন হেপাটাইটিস -এর ধরন ও লক্ষণ
হেপাটাইটিস লিভারের একটি প্রদাহ। যা হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ভাইরাসের মাধ্যমে ঘটে। দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে।
যা প্রাথমিক অবস্থায় শরীরে কোনো উপসর্গ প্রকাশ না করলে ধীরে ধীরে মারাত্মক হয়ে ওঠে।
হেপাটাইটিস লিভারের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কময়ে দিতে শুরু করে। জানেন কি, প্রতি বছর লিভারের এই রোগে বিশ্বব্যাপী এক কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তবে এই রোগ ছোঁয়াচে নয়।
সতর্ক থাকা জরুরি
বর্ষার এ সময় সময় হেপাটাইটিস রোগেরও প্রাদুর্ভাবও ঘটে থাকে। তাই সতর্ক থাকা জরুরি। সাধারণত দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে এই রোগ শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
শরীরে রোগের বিস্তার না ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট লক্ষণ ধরা পরে না। তবে দীর্ঘদিন শরীরে হেপাটাইটিস বাসা বাঁধলে যখন তা লিভারে আক্রমণ করে; তখন নানা লক্ষণ প্রকাশ পায়।
যেমন- শরীর দুর্বল, বমি বমি ভাব, পেটব্যথা, শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করা এবং হলুদ প্রস্রাবের মতো উপসর্গ ইত্যাদি। শরীরে এই রোগের বিস্তার ঘটলে পেটে জল আসা, রক্ত পায়খানা ও রক্তবমি হতে পারে।
হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ধরন ও লক্ষণসমূহ
হেপাটাইটিসের ৫টি ভাইরাস হলো এ, বি, সি, ডি এবং ই। এর মধ্যে টাইপ-বি এবং সি মারাত্মক রূপ নেয় এবং লিভার সিরোসিস এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক আকার ধারণ করে।
প্রাথমিক অবস্থায় তা চিকিত্সা না করলে গুরুতর হয়ে ওঠে এবং লিভার সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
হেপাটাইটিস এ
দূষিত খাবার এবং জলের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। এ রোগের ক্ষেত্রে, লিভার ফুলে যাওয়া, ক্ষিদে কমে যাওয়া, জ্বর, বমি এবং জয়েন্টে ব্যথা মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
এসব লক্ষণ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে।
হেপাটাইটিস বি
এই ভাইরাসটি রক্ত, ঘাম, লালা, বীর্যসহ বিভিন্ন দেহনিঃসৃত তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত রক্তে অবস্থিত ভাইরাস এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থিত অ্যান্টিবডি থেকে এ রোগ নির্ণয় করা হয়।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস লিভারে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এ কারণে রোগীর বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, কোলিক, ত্বকের হলুদ রঙের মতো সমস্যা দেখা দেয়।
এটি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগ যা লিভার সিরোসিস এবং ক্যান্সারের রূপ নেয়। যদি কোনো গর্ভবতী নারী এতে আক্রান্ত হন; তবে তার গর্ভস্থ শিশুও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
হেপাটাইটিস সি
হেপাটাইটিস এ এবং বি এর চেয়েও বেশি বিপজ্জনক এই ভাইরাসটি।
রক্ত দেওয়া-নেওয়া, শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের সময় যদি জীবাণুযুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকে হেপাটাইটিস সি এর সংক্রমণ হয়।
পৃথিবী জুড়ে আনুমানিক ১৩০-১৭০ মিলিয়ন লোক হেপাটাইটিস সি রোগে আক্রান্ত।
হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ব্যক্তির তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ফলে লিভারের ক্ষত এবং বেশ কয়েক বছর পর সিরোসিস সৃষ্টি করে।
আবার অনেক সময় সিরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার অকার্যকর, যকৃতের ক্যান্সার, বা খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর শিরা স্ফীত হতে পারে। যার ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়াও ত্বকে চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।
হেপাটাইটিস ডি
হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগীদের ঝুঁকি থেকে বেশি থাকে এই ভাইরাসে।
এটি দূষিত রক্তের সংক্রমণ, সংক্রামিত সূঁচ ব্যবহার বা শেভিংয়ের অন্যান্য কিটগুলির ব্যবহারের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।
লিভারের সংক্রমণের ফলে বমি ও হালকা জ্বর হয়।
হেপাটাইটিস ই
এই ভাইরাস দূষিত খাবার দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগী ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, ত্বকের হলুদ হওয়া এবং হালকা জ্বর অনুভব করে।
এ সংক্রমণের ফলে রোগী ক্লান্তি, ওজন হ্রাস, ফ্যাকাশে ত্বক ও চেহারা এবং জ্বরের মতো লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
হেপাটাইটিসের বিভিন্ন ধরণ ও লক্ষণ যদি আপনার শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে মিলে যায়; তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে।
উল্লেখ্য, আগামী ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্সের আহ্বানে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হবে। “হেপাটাইটিস, আর অপেক্ষা নয়” প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হবে।