চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহতদের সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী।
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ছয়জন। হতাহতদের সবার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার আমান বাজারে।
আজ শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুরে বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবির হোসেন।
তিনি জানান, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী একটি ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খায় মাইক্রোবাসটি। এতে ঘটনাস্থলে ১১ জন মারা যান।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ট্রেনটি ছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাইক্রোবাসটি করে কয়েকজন খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখতে এসেছিলেন। তবে নিহতদের বিস্তারিত পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কা, প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য
ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের যাত্রী নিহতের ঘটনায় পুলিশ ও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, খৈয়াছড়া ঝরনা নামের পর্যটন স্পট থেকে গোসল করে ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ট্রেনটি ধাক্কা দেওয়ার পর মাইক্রোবাসটিকে প্রায় এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায়। হতাহত সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী।
রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলী গনমাধ্যমকে জানান, ট্রেনটি বড়তাকিয়া ক্রস করার সময় লাইনে উঠে যায় মাইক্রোবাসটি।
এ সময় ইঞ্জিনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসটি কিছু দূর চলে যায়। লেবেল ক্রসিংয়ের বাঁশ ঠেলে মাইক্রোবাসটি লাইনে ওঠে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার পর ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানান, আনসার আলী।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, খৈয়াছড়া এলাকায় রেলওয়ের ওপর দিয়ে একটি সড়ক পথ গেছে। সেখানে রেলওয়ের নিযুক্ত গেটম্যানও আছে।
দুর্ঘটনার পরপর গেটকিপারে সঙ্গে কথা বলেছি।
গেটকিপার আমাকে জানিয়েছেন, ট্রেন আসার আগেই গেট ফেলা ছিল। কিন্তু মাইক্রোবাসের চালক গেটবারটি জোর করে তুলে রেললাইনে প্রবেশ করেন। এরপর মহানগর প্রভাতী ট্রেন মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দেয়। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি।
সীতাকুণ্ড রেলওয়ে পুলিশের ইনচার্জ খোরশেদ গনমাধ্যমকে আলম বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেন ও মাইক্রোবাসের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। তবে নিহতের সংখ্যা এখনো বলা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে মাইক্রো বাসে থাকা সকলে মারা গেছেন।
লাল পতাকা উড়িয়ে গেটম্যান বারণ করেছিল, মাইক্রোবাস চালক শুনেননি
- মাইক্রো চালককে দায়ী করছে রেলওয়ে
- গেটম্যানের কথা শোনেননি মাইক্রোচালক
রেলওয়ে বলছে, গেটম্যান লাল পতাকা উড়িয়ে বারণ করলেও মাইক্রোচালক শুনেননি। তার অবহেলার কারণেই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এইদিকে, মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হওয়ার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে।
দুর্ঘটনার পরপরই বিভাগীয় পার্সোনেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) আনছার আলীকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠন করা হয় বলে গনমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা গনমাধ্যমকে বলেন, ‘সেখানে রাস্তায় ক্রসিংয়ে সাদ্দাম নামের একজন গেটকিপারের দায়িত্বে ছিলেন। তার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি।
তিনি দাবি করেছেন যে সময়মতোই ক্রসিং বার ফেলেছিলেন। তার কথা অমান্য করে মাইক্রোবাসের চালক বারটি তুলে রেললাইনে গাড়ি তুলে দেয়। এতেই দুর্ঘটনাটি ঘটে।’
খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখতে গিয়েছিলেন নিহতরা
ট্রেনের ধাক্কায় নিহত ১১ জনের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। তবে তারা খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখতে গিয়েছিলেন বলে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে। ঝর্ণা দেখে ফেরার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
হৃদয়ের মায়ের আকুতি
আল্লাহ আমার হৃদয়কে ফিরাইয়া দেন, তারে ছাড়া আমি বাঁচবো না’। শুক্রবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের বসে এভাবেই বিলাপ করছিলেন তানভীর হাসাস হৃদয়ের মা লাকি আক্তার।
মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসে থাকা পর্যটকদের একজন তানভীর হাসান হৃদয় হাটহাজারী থানার আমান বাজার শিকারপুর এলাকার প্রবাসী আব্দুর রহমানের ছেলে।
সে হাটহাজারীর কে.সি শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি শিক্ষার্থী। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাকি আক্তার বলেন, ‘সকালে বাড়িতে মেহমান আসার কারণে হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি। গত রাতে ছেলেকে বেড়াতে না যেতে নিষেধ করেছি, ছেলে শুনে নাই।
হৃদয়ের অপেক্ষা থাকা নানি চেনু আরা বেগম বলেন, আল্লাহ যেন হৃদয়কে ফিরিয়ে দেন৷ হৃদয় ছাড়া আমাদের কেউ নেই৷ আমার একমাত্র নাতি, তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন।
জানা গেছে, মাইক্রোবাস যোগে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় ভ্রমণে যান আমান বাজারের আর এন জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থীরা।
মিরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনা, গেটম্যান সাদ্দাম আটক
মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জনের নিহতের ঘটনায় ওই রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দামকে আটক করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দীন এ নিশ্চিত করে বলেন, শুক্রবার (২৯ জুলাই) বিকেল ৬টার দিকে রেলওয়ে পুলিশ তাকে আটক করেছে।
দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ট্রেন আসার সিগন্যাল পেয়ে ওই ক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দাম বাঁশ ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। সেই বাঁশ ঠেলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ওপর উঠে যায়।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী মফিজুল হকসহ কয়েকজন ভিন্ন তথ্য জানান।
তারা দাবি করেন, দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান সাদ্দাম সেখানে ছিলেন না। তিনি জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। বাঁশ ফেলে ক্রসিংয়ে ব্যারিকেড করা হয়নি বলে দাবি তাদের।
এসএসসি শেষে কানাডায় মায়ের কাছে ফেরার কথা ছিল ইশামের
তবে মায়ের কোলে আর ফেরা হলো না ইশামের। মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে মেধাবী ইশাম।
ইশাম জন্মের পরপরই বাবাকে হারান। ২০০৭ সালে তার বাবা মারা যান। তার মা বর্তমানে কানাডায় থাকেন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ইশাম (১৬)। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে তার পরীক্ষা শুরুর দিনক্ষণ ঠিক ছিল। পরীক্ষা দিয়েই কানাডায় মায়ের কাছে চলে যাওয়ার কথা ছিল ইশামের।
নিহত- আহতদের পরিচয় মিলেছে
ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ১৭ যাত্রীর পরিচয় মিলেছে।তারা সবাই হাটহাজারীর আর এণ্ড জে নামক একটি কোচিং সেন্টারের ছাত্র শিক্ষক।
এ ঘটনায় ছাত্র শিক্ষকসহ ১১ জনই ঘটনাস্থলে মারা যায়। এছাড়া আহত ৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত ছয়জন হলেন— মাইক্রোবাসের হেলপার তৌকিদ ইবনে শাওন (২০), একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মাহিম (১৮), তানভীর হাসান হৃদয় (১৮), মো. ইমন(১৯), এসএসসি পরীক্ষার্থী তছমির পাবেল (১৬) ও মো. সৈকত (১৮)।
অন্যদিকে নিহত ১১ জনের মধ্যে নয় জনের পরিচয় মিলেছে। এরমধ্যে কোচিং সেন্টারের চার শিক্ষক জিসান, সজীব, রাকিব এবং রেদোয়ান। এছাড়া কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী হিশাম, আয়াত, মারুফ, তাসফির, হাসান।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা ইমন বললেন গেটম্যান ছিল না
সড়কের রেল ক্রসিংয়ের সিগন্যাল বা প্রতিবন্ধক যাওয়া ও আসার সময় ছিল না। যাওয়ার সময় রেলে আসতেছিল সেখানে থাকা গেটম্যানের রুম থেকে একজন বলেছে রেল আসছে, রেল দূরে আছে, আপনারা চলে যান।
ট্রেনের ধাক্কায় চুরমার হওয়া মাইক্রোবাসে থাকা আহত জুনাইদ কাউসার ইমন গনমাধ্যমকে বলেন, গেটম্যানের রুমটা তালাবদ্ধ ছিল, কোন ধরনের গেটম্যান ছিল না।
অতিরিক্ত বৃষ্টি পড়ছিল চারদিকে দোকান ছিল, যার কারণে চালক রেললাইনের দিকে নজর দেয়নি। রেল আসছে সেটা দেখা যায়নি, আমি মাইক্রোবাসের শেষের সিটে বসে ছিলাম।
রেললাইনে উঠার সঙ্গে সঙ্গে রেল মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে সামনে নিয়ে যায়।
আমি মাইক্রোবাসের কাচ ভেঙে বের হয়ে যাই। স্থানীয় বাসিন্দা ও পরে জাতীয় জরুরি সেবায় কল দিলে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস পুলিশ আসেন।
জুনাইদ কাউসার ইমন হাটহাজারী থানার আমান বাজার খন্দকিয়া এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি হাটহাজারীর কেসি শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র।
আরও পড়ুন…..