নানা অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা, বাড়াচ্ছে এইডসের ঝুঁকি!

google news

রোহিঙ্গামিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অপহরণ, মাদক, জাল টাকার অবৈধ ব্যবসা, ডাকাতি, স্বর্ণ চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলেছে, গ্রেপ্তার ও আইনি ব্যবস্থা নিয়েও কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এইডস (এইচআইভি) রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত এক বছরে কক্সবাজারে ১১৫ জন রোহিঙ্গা ও ১০জন বাংলাদেশির এইডস শনাক্ত হয়েছে।

অপহরণ-চোরাচালানসহ নানা অপরাধে বাড়ছে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা

  • এই বছরের প্রথম ছয় মাসে মাদক, টাকা ও স্বর্ণের বারসহ ১১৬ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে

ইয়াবা, আইস ও ফেনসিডিলসহ মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের অধিকাংশই রোহিঙ্গার এমনটা জানাল পুলিশ।

পুলিশ বলছে, রোহিঙ্গারা শুধু মাদক ব্যবসায় সীমাবদ্ধ নয়; জড়িত ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও কন্ট্রাক্ট কিলিং এর মতো বড় ধরনের অপরাধেও।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তথ্য…

চট্টগ্রামের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ৪৬২ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তাদের কাছ থেকে ১,৩২৯,৮২৫ পিস ইয়াবা, প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার টাকা ও তিনটি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়েছে।

অধিদপ্তরের সূত্র আরও জানায়, ২০১৭ সালে ১৩ জন, ২০১৮ সালে ৩০ জন, ২০১৯ সালে ২৬ জন, ২০২০ সালে ৯১ জন।

২০২১ সালে ১৮৬ জন এবং এই বছরের জুন পর্যন্ত মাদক, টাকা ও স্বর্ণের বারসহ ১১৬ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যাতি চাকমা বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গারা এখন উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক বেচাকেনা ও বহনে ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। পাশা-পাশি জড়িয়ে পড়েছে সোনা চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধেও।

জাল নোট-চোরাচালানে রোহিঙ্গারা

কোতোয়ালি থানা সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার ১৮ হাজার টাকার জাল নোটসহ তিন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।

কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল কবির  বলেন, “গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জাল টাকাসহ তিন রোহিঙ্গাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। আগে ইয়াবাসহ একাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

জাল টাকাসহ গ্রেফতারের ঘটনা এবারই প্রথম। তারা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তিন রোহিঙ্গা পালিয়ে চট্টগ্রামে এসেছিল বলে জানিয়েছে আমাদের। মাদক ছাড়াও হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছে তারা।

এর আগে শুক্রবার চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর এলাকা থেকে দেড় কোটি টাকার স্বর্ণের বারসহ মা-ছেলেকে আটক করা হয়।

তারা পরিচয় গোপন করে ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন। তাদের কাছ থেকে আটটি স্বর্ণের বার, পাঁচটি চেইন, এক জোড়া চুড়ি, তিন জোড়া কানের দুলসহ আরও কিছু মালামাল জব্দ করা হয়েছে।

অপহরণে জড়িত রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা

এদিকে গত দুই দিনে পৃথক ঘটনায় চার বাংলাদেশিকে অপহরণ করেছে রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা। তারা মুক্তিপণও দাবি করেছে।তবে

সোমবার সন্ধ্যায় পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা অপহরণকারীদের আটক করতে সক্ষম হয়।আট ঘণ্টার অভিযানের পর অপহৃত চারজনকে উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপত্তা জোরদার করায় রোহিঙ্গারা এখন পালিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১৬) ক্যাপ্টেন তরিকুল ইসলাম বলেন, “আমার এলাকায় সাত মাসে ৩০টি অপহরণের ঘটনায় দুই বাংলাদেশিসহ ৩৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচটি মামলায় সাত অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা খুবই স্পষ্ট যে রোহিঙ্গারা মাদকের জন্য এসব অপরাধ করছে।”

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে এইডস রোগী

সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এইডস (এইচআইভি) রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশাপাশি এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রাও।

গত এক বছরে কক্সবাজারে ১১৫ জন রোহিঙ্গা ও ১০জন বাংলাদেশির এইডস শনাক্ত হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত এসব রোগী শনাক্ত হয়েছে।

২০১৫ সাল থেকে জেলায় এ পর্যন্ত এইডস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭১০ জন, এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ৬১২ জন। আর সব মিলিয়ে মারা গেছেন ১১৮ জন।

এইচআইভি-এইডস নিয়ে কাজ করা এনজিও ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালের এইচআইভি ট্রিটমেন্ট সেন্টার সূত্রে পাওয়া গেছে ভয়াবহ চিত্র।

রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও রয়েছে এইডস ঝুঁকিতে

কক্সবাজারে আশঙ্কাজনক বিস্তার ঘটছে এইডসের। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এইডস রোগের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও রয়েছে এইডস ঝুঁকিতে।

পেশাদার-অপেশাদার যৌনকর্মী ও মাদকাসক্তদের অবাধ যৌনাচারের কারণে এ রোগ বাড়ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ও এইচআইভি ফোকাল পারসন ডা. আশিকুর রহমান বলেন, “২০১৫ সাল থেকেই কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইচআইভি বা এইডস স্ক্যানিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। যেখানে এইডস নির্ণয়, কাউন্সিলিং ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হিজড়ার শরীরেও এইচআইভি

রোহিঙ্গাদের বাইরে যারা আছেন, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসার আওতায় আনার বিষয়ে আমরা কাজ করছি।

গত ৬ জুলাই পর্যন্ত ৭১০ জনের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে।

হিজড়ার শরীরেও এইচআইভির জীবাণু পাওয়া গেছে। এ রোগে জেলায় আক্রান্ত ৬১ রোহিঙ্গাসহ ১১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

তবে, এইডস আক্রান্ত জীবিতরা কে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছে তার কোনো হিসাব সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।

ডা. আশিকুর রহমান বলেন, “আমাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা ভিন্ন রোগ নিয়ে আসছে। চিকিৎসা পরীক্ষায় ধরা পড়ছে এইচআইভি।“

এইডস/এইচআইভি প্রতিরোধে জেলা সদর হাসপাতালে নানা উদ্যোগ ছাড়াও মাঠপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ১২টি টিম কাজ করছে বলে জানা গেছে।

কক্সবাজার এইডসের জন্য এখন বিপজ্জনক এলাকা

কক্সবাজার এইডসের জন্য এখন বিপজ্জনক এলাকা এমনটা বলছেন, চিকিৎসকরা। রোহিঙ্গারা যে হারে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সে তুলনায় শনাক্ত করা হচ্ছে কমই। প্রকৃত অর্থে আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

সূত্র বলছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউসে ৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা তরুণীর যাতায়াত।

তারা অনিরাপদভাবেই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও স্থানীয়দের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করছে।

এতে কক্সবাজারে এই রোগ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।

রোহিঙ্গা যৌনকর্মী ছাড়াও পর্যটন শহর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে যৌনকর্মীদের ব্যাপকহারে কক্সবাজার আগমনও এইডস বিস্তারের আরেকটি অন্যতম কারণ।

কক্সবাজারের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, এইচআইভির বিস্তারের নেপথ্যে রয়েছে অসচেতনতা। রয়েছে সামাজিক নানা কুসংস্কার।

এসব মিলে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। অন্য সব রক্ষণশীল সমাজের মতোই কারো দেহে এইচআইভি পাওয়া গেলে তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে। যাদের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে তারাও চিকিৎসা নিতে গড়িমসি করে।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অনেক স্থানীয় যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছে।এছাড়াও কক্সবাজার হোটেল মোটেল জোন এলাকায় শত শত রোহিঙ্গা নারীদের অবাধ বিচরণ।

সেখানেও যৌনকর্মে লিপ্ত হচ্ছে স্থানীয়সহ রোহিঙ্গারা। যদি সচেতনতা বাড়ানো যায়, তাহলে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা জনগণ একটি রাষ্ট্রহীন ইন্দো-আর্য জাতিগত গোষ্ঠী যারা প্রধানত ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসবাস।

রাখাইন রাজ্যে সামরিক দমন-পীড়ন শুরু হলে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি জমায়।

এর আগে, বাংলাদেশে আরও প্রায় ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল।

আরও পড়ুন…

মতামত দিন