অনিয়মে জর্জরিত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়: ইউজিসির প্রতিবেদন, ভিসি অপসারণের সুপারিশ

google news

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসিইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি। ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আহসান উল্লাহর অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অনিয়মের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি ডুবতে বসেছে।

নৈতিকতা শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি এখন ভিসি ও তার ঘনিষ্ঠ অনুসারিদের অনিয়ম, জালিয়াতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি হিসেবে যোগদান

ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় অবস্থিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম উপাচার্য (ভিসি) হিসেবে ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি যোগ দেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ।

এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মেয়াদ শেষ হলে সরকার তাকে দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ দেয়।

দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে আসতে থাকে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ।

তদন্ত করে সেসব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

ভিসির অপসারণসহ বেশকিছু সুপারিশ

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির অপসারণসহ বেশকিছু সুপারিশও করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের হেনস্তা, নিয়মবহির্ভূত পদোন্নতিসহ রয়েছে বেশকিছু অভিযোগ।

এছাড়া উপাচার্যের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত একাধিক অভিযোগও রয়েছে।

সম্প্রতি ইউজিসি থেকে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

সেই প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে উপাচার্যের দেওয়া সব নিয়োগ-পদোন্নতি বাতিলের। একই সঙ্গে উপাচার্য আহসান উল্লাহকে অপসারণেরও সুপারিশ করা হয়েছে।

তবে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে উপাচার্য দাবি করেন, প্রশ্ন তৈরির জন্য এসব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভিসি হওয়ার পর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় ও স্বজনপ্রীতি করেছেন আহসান উল্লাহ।

সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন তার নিজের এলাকা চট্টগ্রাম থেকে।

পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে গিয়ে বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করেছেন।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই দিয়েছেন নিয়োগ। আবার যাদের নিয়োগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ১০-১৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।

আর ৫-১০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে কর্মচারীদের থেকে। ৫২ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১১২ জনকে। এছাড়া বাড়িভাড়ার নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি।

এদিকে প্রথম দফায় ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে হয় এ তদন্ত।

এরপর দ্বিতীয় দফায় তদন্ত করে ইউজিসি। সেখানেও সত্যতা মেলে অভিযোগের। এ তদন্ত কমিটিতে ইউজিসির সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ্রসহ পাঁচ সদস্য ছিলেন।

দ্বিতীয় দফার তদন্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়

দ্বিতীয় দফার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হেলাল উদ্দীন এসব অনৈতিক ও অবৈধ নিয়োগের বিরোধিতা করায় তাকে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়া হয়।

কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে জালিয়াতির জন্য অবৈধভাবে ‘নিয়োগ কমিটি’র বাইরে আলাদা প্রশ্নপত্র করা হয়। এছাড়া অবৈধভাবে এক লাফে ১৩ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বানানো হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আইন অনুযায়ী ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকে গড়ে তোলা হলেও অপ্রয়োজনে উপাচার্যের পছন্দের বেশ কয়েকজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে চাইলে প্রশ্ন মডারেটর ও প্রণয়নের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় বলে দাবি করেন উপাচার্য।

এছাড়া নিয়মে নেই এমন অধীনস্থ মাদরাসায় বিভাগ খোলার অনুমোদন দেওয়া হয় বলে তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়।

এর আগে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন সাব্বির আহমেদ মমতাজী। তার সংশ্লিষ্টতায় মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন আহসান উল্লাহ। মমতাজীর বিরুদ্ধেও নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল।

ক্ষমতাবলে তিনি নিজের ছেলে-মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এসব অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি।

ইউজিসির সুপারিশ

উপাচার্য আহসান উল্লাহর দেওয়া ১১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল করে পুনরায় নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা।

তবে যারা ‘অবৈধভাবে’ নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

সিন্ডিকেট সদস্যের কয়েকজন উপাচার্যের সহযোগী হিসেবে কাজ করায় এ সিন্ডিকেট ভেঙে নতুনভাবে গঠন করা ও আহসান উল্লাহকে অপসারণ করে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম গনমাধ্যমকে বলেন, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বর্তমান উপাচার্যের অনিয়ম প্রমাণ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

ভিসির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:

ইউজিসির পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিতেই ভিসিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আহসান উল্লাহ চট্টগ্রাম বাকুলিয়া থানার জামায়াতে ইসলামির ১৩ নং ক্রমিকের রুকন।

তিনি এখনও ভিতরে ভিতরে জামায়াতে ইসলামির সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখেন।

তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াত জোট সমর্থিত প্যানেলে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও একজন প্রার্থী ছিলেন।

ইউজিসির চিঠিতে বলা হয়, তিনি ধর্ষণকারী হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। চট্টগ্রামে দুটি মাদরাসায় চাকরি করার সময় ধর্ষণের অপরাধে জুতা পেটা করা হয়েছিল তাকে।

২০১৮ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামে একটি শিশুকে বলাৎকার করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন এবং জনগণের হাতে লাঞ্চিত হন। যা বিভিন্ন ডিজিটাল ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ভাইরালও হয়েছিল।

আরও পড়ুন…

মতামত দিন