রূপ বদল করে চলছে করোনাভাইরাস। ভারত মহামারীতে বিপর্যস্ত হওয়ার কারণ হিসেবে এই ধরনটিকে দায়ী করা হচ্ছে; তার নাম দেয়া হয়েছে ডেল্টা।
ঢাকা শহরে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ রোগীর শরীরে অতিসংক্রামক ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়ার যে তথ্য আইসিডিডিআর,বি গবেষণায় উঠে এসেছে।
এই ধরন বা ভ্যারিয়েন্টটি (বি.১.৬১৭.২) অতি সংক্রামক হওয়ায় একে ‘বিশ্বের জন্য উদ্বেগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন চার হাজার ৬৩৬ জন। ২১ জুন এই তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার আগের দিন শনাক্ত হন তিন হাজার ৬৪১ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৮ জন, তার আগের দিন ৮২ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছিল।
দেশে শনাক্ত রোগী বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শনাক্তের হারও। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৭৩ শতাংশ আর মৃত্যু হার এক দশমিক ৫৯ শতাংশ।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দেয়ার পরের বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গত বছরের শেষ দিকে এসে সংক্রমণ কমতে থাকে।
তবে চলতি বছরের মার্চ থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে। সেময় দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের ওপরে চলে যায়। বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যাও। একইসঙ্গে বাড়তে থাকে মৃত্যুও।
গত ১৯ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর মহামারিকালে একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যুর কথা জানায়। সেসময় শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় পাঁচ এপ্রিল থেকে মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা এখনও বহাল রয়েছে।
এ বিধিনিষেধের ফলাফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সে বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে পড়ে।
শহর ছেড়ে যাওয়া মানুষ গ্রামমুখী হয়, যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনও বালাই ছিল না। তাতে করে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করেন ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে।
সেইসঙ্গে দেশে ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রোগী বাড়তে শুরু করেছে, হাসপাতালে জায়গা দিতে করোনা বেড বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা হাসপাতালগুলো।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। যার ফলে প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলা এবং পরে সেসব জেলা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পাশের জেলাগুলাতেও।
যার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাড়ছে।
একইসঙ্গে ঢাকায় করোনা আক্রান্ত ৬০ ব্যক্তির নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স করে ৬৮ শতাংশই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৬০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে জানিয়ে আইসিডিডিআরবি সূত্র জানায়, সংগৃহীত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে এর ৬৮ শতাংশ ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ২২ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এবং বাকি নমুনাগুলো ১২ শতাংশ নাইজেরিয়ার ইটা ভ্যারিয়েন্ট।
দেশে এ তিন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতায় করোনা সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানী ঢাকার সরকারি চারটি বড় হাসপাতালেই আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ফাঁকা নেই বলে জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে।
আর ঢাকার বাইরের কোনও কোনও হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে।
এদিকে, করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় চলতি জুন মাস গত মাসের মতো স্বস্তিকর যাবে না বলে মনে করছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর।
গত ৬ জুন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে এ শঙ্কার কথা বলেন অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। তারা বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণক্ষমতা আগের সব ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্রুত। ফলে এটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
সেই সঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা। সীমান্তবর্তী জেলাসহ তার আশেপাশের জেলাগুলোতে হাসপাতালে উপচে পড়ছে রোগী।
এখনই যদি সংক্রমণের লাগাম না টেনে রাখা যায় তাহলে করোনার এবারের ঊর্ধ্বগতি আগের সব বিপর্যয়কে ছাড়িয়ে যাবে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে আরও বিপর্যয় আসছে।
তার মতে, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না। সরকার এসব মানাতে পারবে বলেও মনে হচ্ছে না।
সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকি বাড়বে। জুন মাসতো শেষ হয়ে গেছে প্রায়। জুলাই-আগস্ট নাগাদ এরকম বাড়তে থাকবে। তারপর হয়তো কমতে থাকবে, বলেন তিনি।
সীমান্ত দিয়ে করোনার ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন সেটা পুরো দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
এখন সেটা জেনারালাইজড হয়ে গেছে মন্তব্য করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যেসব শহরে শনাক্তের হার ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে এখন সেসব প্রতিটি জেলাতে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
এ ছাড়া তুলনামূলক কম জরুরি অফিস আদালত বন্ধ করে দেওয়াও দরকার।
আগে শনাক্তে হার ছিল ধীরগতির কিন্তু এবারে বাড়ছে দ্রুত গতিতে। আগে এটা হয়নি জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণ বাড়ছে। ঢাকাতে এখনও শনাক্তের হার ১০ এর নিচে রয়েছে, কিন্তু যদি সেটা ২০ শতাংশের ওপরে উঠে যায় তাহলে সব বন্ধ করেও তখন লাভ হবে না।
এখন যদি সংক্রমণ বাড়তেই থাকে, আর তার সঙ্গে যদি কোরবারি ঈদের চলাচল যোগ হয়ে যায়; তাহলে সেটা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবে।
তাই এখন সংক্রমণ কমানো দরকার। আগাম অ্যাকশন নিতে হবে, নয়তো এটা রোধ করা যাবে না- বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।
দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট
করোনার আগের স্ট্রেইনগুলোর চেয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আরও বেশি সংক্রামক; পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যে করোনা সংক্রমণের ৯০ শতাংশেরও বেশি হলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।
আবুধাবি থেকে প্রকাশিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইংরেজি দৈনিক দ্য ন্যাশনাল এর এক প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে জানা-অজানা অনেক তথ্য দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ইস্ট অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক পল হান্টার বলেছেন, চিকিৎসকরা সম্প্রতি এই ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে নানারকম উপসর্গ দেখতে পেয়েছেন।
যার অর্থ করোনায় সংক্রমিত হওয়ার শুরুতে আগে যেমন কাশি ছিল পরিচিত উপসর্গ, সেটি আর থাকছে না।
করোনার ‘সাধারণ’ উপসর্গগুলি কি কি?
করোনায় সংক্রমিত বেশিরভাগ মানুষের শুকনো কাশি হয়, গায়ে জ্বর অনুভব করেন, ঘ্রাণ ও স্বাদ কমে যায়।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট কি?
গত অক্টোবর মাসে ভারতে শনাক্ত হওয়া ভ্যারিয়েন্টের নাম হলো ডেল্টা। সেখানে এটি মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাধ্যমে বিপর্যয় ঘটায়।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট কি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে?
বিশ্বের ৬২ টির বেশি দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাপ্তাহিক মহামারী সংক্রান্ত আপডেটে বলা হয়েছে যে এটি সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত এবং কাতারে ধরা পড়েছে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের লক্ষণগুলো আলাদা কিভাবে?
অধ্যাপক হান্টার জানান, চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের লক্ষণের দেখা পেয়েছেন। তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে ঠান্ডা লাগার মতো আরো কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যেমনঃ গলা ব্যথা এবং হাঁচি”।
জ্বর আসাটা খুব সাধারণ উল্লেখ করে তিনি জানান, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি চলে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। মাথা ব্যথা এবং সর্দি বেড়ে যাওয়া সাধারণ লক্ষণ হিসেবে রেকর্ড করা হচ্ছে।
লক্ষণগুলো কেন পরিবর্তিত হতে পারে?
অধ্যাপক হান্টার জানান, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে শরীর বিভিন্ন ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। “এটি আমাকে অবাক করে না কারণ অন্য ধরনের করোনা ভাইরাসগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়- প্রধানত চারটি উপসর্গ রয়েছে – এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ সর্দি জাগায়।
এটিও সম্ভব যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমিতদের মধ্যে কেউ কেউ এর আগে সংক্রমিত হয়েছিল বা ভ্যাকসিন নিয়েছিল।
অতএব, তাদের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কারণ তাদের কাছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইতিমধ্যে অ্যান্টিবডি রয়েছে।
এসব জানা জরুরী কেন?
কেউ যদি মনে করে যে তার কেবল ঠাণ্ডাই লেগেছে তবে সে করোনার পরীক্ষা করার কথা চিন্তাই করতে পারে না। এর ফলে অধিক সংখ্যক সংক্রমিত ব্যক্তিরা নিত্যদিনের মতো জীবনযাপন করেন এবং এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সংখ্যা বেড়ে যায়।