প্রযুক্তির অগ্রগতি গত চার দশকে কৃষিতে নিয়ে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য।
ফসলকে ক্ষতিকর পোকা ও কীট থেকে বাঁচাতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করছেন কৃষকেরা।
ইঁদুরের উপদ্রব থেকে ফসলকে বাঁচাতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ।
তবে ইঁদুর নিধনের প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে কৃষকরা একরকম অজ্ঞাত।
সরকারও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, বিষ ও গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করে কার্যকরভাবে ইঁদুর নির্মূলের কথা প্রচার করে আসছে।
এছাড়া প্রতি বছর ইঁদুর নিধন সপ্তাহে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। নিধনকারীদের পুরস্কৃতও করা হয়।
২০২০ সালে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে ধানের ক্ষেত বাঁচাতে ছয়শত ইঁদুরনিধনকারীকে পুরস্কার দেয় সরকার।
তবে এসব রাসায়নিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
এসব পদ্ধতি ব্যবহারে ফসলের জন্য উপকারী কিছু পোকামাকড়েরও মৃত্যু হয়।
যা ফসলের পরাগায়নেও বিরূপ প্রভাব রাখে।
ইঁদুর কতটা ক্ষতিকর?
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কালো, লোমযুক্ত ও ছোট-লেজের ইঁদুর সাধারণত বছরের শুরুতেই ধানক্ষেত এবং গুদামে দেখা যায়।
আমন মৌসুমে এরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ইঁদুরের প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই তাদের নির্মূল করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে অধিদপ্তর।
কর্মকর্তারা বলছেন, ইঁদুর মোট উৎপাদিত ধান ও গমের প্রায় ১০% নষ্ট করে।
এছাড়া বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, কুয়াশা, অন্যান্য কীটপতঙ্গ ও মহামারি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। ধারণা করা হয়, ইঁদুর বছরে ৭ লাখ টন খাদ্যশস্যের ক্ষতি করে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা “কৃষি সেবা”য় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এশিয়ার ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোতে ইঁদুরকে ক্ষতিকর কীট হিসেবে মনে করা হয়।
এই প্রাণীটি ধানের পাক ধরার সঙ্গে সঙ্গে ফসলের ক্ষেতে আক্রমণ চালায়।
ধানের শিষ কেটে দেয়। এছাড়া গুদামে সংরক্ষণ করা ধানের ৫ থেকে ১০% নষ্ট করে।
নিবন্ধে ইঁদুরের জীবনচক্র ও নির্মূলের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
নিবন্ধটি লিখেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শীর্ষ তিন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে চিন্তা
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিবন্ধটি ফসলের ক্ষেতে ইঁদুরের বিস্তার রোধের জন্য প্রাকৃতিক পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, “ইঁদুর খাদকদের সুরক্ষা ও প্রজননের সঠিক ব্যবস্থাপনা বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃঙ্খল বজায় রাখার পাশাপাশি সমস্যাটি অনেকাংশে কমিয়ে দেবে।
এই প্রাণীটি দাঁড়াশ সাপ, বন বিড়াল, পেঁচা ও শেয়ালের প্রধান খাবার। এই প্রাণীগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রজনন ও কৃষক পর্যায়ে লালন-পালনের ব্যবস্থা করলে উপকার পাওয়া যাবে।
এই প্রাণীগুলো কৃষির জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু দ্রুত নগরায়ন, বাসস্থানের ক্ষতি ও দূষণের কারণে অনেক জায়গা থেকে প্রাণীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
কুসংস্কার, ভয় ও প্রাণীগুলোর উপকারের কথা না জানায় কৃষকেরাও তাদের হত্যা করছেন।
দাঁড়াশ: প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রক
দাঁড়াশ সাপ কৃষকের নীরব বন্ধু। সারা দেশেই এদের দেখা মেলে।
এ সাপ এখনো বিপন্ন না হলেও আগের মতো তেমন একটা দেখা যায় না। এটি নির্বিষ একটি সাপ। এর ইংরেজি নাম Rat Snake।
বৈজ্ঞানিক নাম Ptyas mucosa। কোনো কোনো এলাকায় এই সাপকে দারাজ সাপও বলা হয়।
এর প্রধান খাবার ইঁদুর। মূলত ইঁদুর খেয়েই সে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি কৃষকের বন্ধু হিসেবে আড়ালে থেকে কাজ করে।
দাঁড়াশ সাপ সর্বোচ্চ ৩৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। প্রাণীটি দেখতে সুন্দর।
দাঁড়াশ সাপ কৃষি জমিতে থাকতে পছন্দ করে। আবাসস্থলের আশপাশে প্রায় ৩ একর এলাকা সে বিচরণ করে এবং এই জায়গায় খুঁজে খুঁজে ইঁদুর শিকার করে।
ফলে ইঁদুরের কারণে যে ফসলহানি ঘটে তা থেকে রক্ষা মেলে।
বাস্তবে কৃষকের বন্ধু হলেও অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের কারণে মানুষের হাতে প্রাণ দিতে হয় প্রতিনিয়ত।
এই সাপের কোমরে বা লেজে কাঁটা থাকে বলে কুসংস্কার রয়েছে।
গ্রামের অনেক মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন, “দাঁড়াশ সাপ গরুকে আক্রমণ করে। গরুর দুধ চুষে খায়।” এটি পুরোপুরি ভুল ধারণা।
কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে “নিরাপদ খাদ্য ও সুবিধাবঞ্চিত” শিশুদের নিয়ে কাজ করেন মারুফ আহমেদ।
তিনি স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাঁড়াশ সাপ সংরক্ষণের প্রচারণা চালিয়ে আসছেন।
মারুফ বলেন, “দাঁড়াশ সাপ কৃষকের বন্ধু। এরা যে এলাকায় থাকেন তার আশপাশের তিন একর এলাকার সমস্ত ইঁদুরকে মেরে ফেলে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক দাঁড়াশ সাপ বছরে ৭০ থেকে ৮০ টি ইঁদুর মারে।
এই ইঁদুরগুলো বেঁচে থাকলে তারা আরও বংশবিস্তার করত।”
তাই দাঁড়াশ সাপ সংরক্ষণ এবং এটি সম্পর্কে প্রচলিত কুসংস্কার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সুত্র – dhakatribune