অনলাইনে কেনাকাটা: ইভ্যালিসহ ১০ ই-কমার্সে অর্থ লেনদেনে ব্র্যাক ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা

google news

ইভ্যালিব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড নিজ গ্রাহকদের প্রতি ইভ্যালী ও আলেশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্স প্লাটফর্ম থেকে ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড এবং প্রি-পেইড কার্ডের মাধ্যমে পণ্য কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

মঙ্গলবার কার্ড হোল্ডারদের কাছে পাঠানো ই-মেইল ও মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহকদের এ তথ্য জানিয়ে দিয়েছে ব্যাংকটি।

নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডট কম বিডি।

অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পরও সময়মত পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব ইভ্যালীসহ কিছু ই-কমার্স প্লাটফর্ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর এ সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ।

মঙ্গলবার (২২ জুন) বিষয়‌টি নিশ্চিত করেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ইকরামুল কবীর বলেন, এটি ব্র্যাক ব্যাংকের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত।

নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নোটিশে ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলেছে, নিম্ন উল্লেখিত ১০টি অনলাইন মার্চেন্টদের সঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ড লেনদেনে ব্যবহার করা যাবে না।

প্রসঙ্গত, ব্র্যাক ব্যাংক প্রথম ব্যাংক হিসেবে আলোচিত অনলাইন মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্ডে লেনদেন স্থগিত করলেও, খুব শিগগির অন্যান্য ব্যাংকও একই পদক্ষেপ নিতে পারে বলে এখাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

ব্র্যাক ব্যাংক
ইভ্যালিসহ ১০ ই-কমার্সে কেনাকাটায় ব্র্যাক ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা

ইভ্যালির সম্পদের চেয়ে ৬ গুণ বেশি দেনা

ইভ্যালীর সম্পদ ও দেনার ব্যবধান অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি পুরনো দেনা মেটাবার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন দেনায় জড়িয়ে পড়ছে। ফলে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছে দেনা বেড়েই চলেছে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

সম্পদের চেয়ে ৬ গুণের বেশি এই দেনা পরিশোধ করার সক্ষমতা কোম্পানিটির নেই বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সম্প্রতি ইভ্যালি.কম.বিডি-এর ওপর পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গত ১৭ জুন (বৃহস্পতিবার) প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ইভ্যালির চলতি দায় ও লোকসান দুটিই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কোম্পানিটি চলতি দায় ও লোকসানের দুষ্ট চক্রে বাঁধা পড়ছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ‘ক্রমাগতভাবে সৃষ্ট দায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব টিকে না থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।’

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইভ্যালি চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নিয়ে কোনো পণ্য সরবরাহ করেনি।

অন্যদিকে তারা যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কেনে, তাদের কাছে ইভ্যালির বকেয়া ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

সব মিলিয়ে ইভ্যালির চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও পাওনাদারদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব।

বাকি প্রায় ৮৪ শতাংশ বা ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব হবে।

২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালির মোট আয় (রেভিনিউ) ২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির বিক্রয় ব্যয় হয়েছে ২০৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কোম্পানিটি প্রতি এক টাকা আয়ের জন্য তিন টাকা ৫৭ পয়সা বিক্রয় ব্যয় করেছে বলে স্টেটমেন্টে দেখিয়েছে এবং এই অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়ে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ইভ্যালির চলতি দায় ও লোকসান দুটিই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কোম্পানিটি চলতি দায় ও লোকসানের দুষ্ট চক্রে বাঁধা পড়েছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ‘ক্রমাগতভাবে সৃষ্ট দায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব টিকে না থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, কোম্পানিটি শুরু থেকেই লোকসান করে আসছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকসানের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইভ্যালি আগের দায় পরিশোধ এবং লোকসান আড়াল করার জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফারের (যেমন-সাইক্লোন, আর্থকোয়েক ইত্যাদি নামে মূলত ব্যাপক হ্রাসকৃত মূল্যে বা লোকসানে পণ্য সরবরাহ) মাধ্যমে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে।

প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ ও দায়ের ব্যবধান অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ক্রমাগত নতুন দায় সৃষ্টির (গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে দায় বৃদ্ধি) মাধ্যমে পুরাতন দায় পরিশোধের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে।

এজন্য নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করতে আরও বেশি হারে ডিসকাউন্ট বা অফার করে যাচ্ছে। এতে সম্পদ ও দায়ের ব্যবধান আরও বাড়ছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির মোট গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৪ জন। ক্রয়াদেশ বাতিল, ইভ্যালির দেওয়া ক্যাশব্যাক, বিক্রিত গিফটকার্ডের সমন্বয়ে এসব গ্রাহকদের ভার্চুয়াল আইডিতে (অ্যাকাউন্ট, হোল্ডিং, গিফটকার্ড, ক্যাশব্যাক) মোট ৭৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা মূল্যমানের ই-ভ্যালু সংরক্ষিত ছিল।

অথচ ওই দিন (২৮ ফেব্রুয়ারি) ইভ্যালি.কম.বিডির ১০টি ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ২.০৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, লোকসানে পণ্য বিক্রি করার কারণে ইভ্যালি গ্রাহক থেকে অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পরও মার্চেন্টদের কাছে তাদের বকেয়া অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।

গ্রাহক ও মার্চেন্টের বকেয়া ক্রমাগত বাড়ার কারণে এক সময় বিপুল সংখ্যক গ্রাহক ও মার্চেন্টের পাওনা অর্থ না পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে এবং এর ফলে সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের দেওয়া ইভ্যালির স্টেটমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল পজিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মার্চ তারিখে ইভ্যালির মোট দায় (ইক্যুইটি বাদে) অপেক্ষা মোট সম্পদের ঘাটতি ৩১৫.৪৯ কোটি টাকা, চলতি দায় (ইক্যুইটি বাদে) অপেক্ষা চলতি সম্পদের ঘাটতি ৩৪২ কোটি টাকা।

অর্থাৎ, ইভ্যালির মোট সম্পদ প্রতিষ্ঠানটির মোট দায়ের মাত্র ২২.৫২ শতাংশ এবং চলতি সম্পদের পরিমাণ চলতি দায়ের মাত্র ১৬.০১ শতাংশ। কোম্পানিটির ১ কোটি টাকার শেয়ার মূলধনের বিপরীতে ২৬.৫১ কোটি টাকার স্থায়ী সম্পদ রয়েছে, কিন্তু কোনো দীর্ঘমেয়াদি দায় নেই।

অনলাইনে কেনাকাটায় থাকুন সতর্ক

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ১ হাজার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। দেশে অনলাইনে কেনাকাটার হার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি।

তবে, অনলাইন কেনাকাটায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতারণা এড়াতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা এড়াতে করণীয় :

● কম দামে লোভনীয় অফার এড়িয়ে চলা।

● প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ।

● ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না, যাচাই করা।

● বিকাশে পণ্যের দাম পরিশোধের বেলায় নম্বর যাচাই করা।

● কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে রসিদ ও ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য গ্রহণ।

● ফেসবুকে কেনাকাটার গ্রুপ বা পেজের রিভিউ দেখে নেওয়া।

● বিশ্বাসযোগ্য ফেসবুক পেজ বা গ্রুপে পণ্য কেনা।

● পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করা যায় এমন গ্রুপ পেজ থেকে কেনাকাটা এবং সব ধরনের রসিদ সংরক্ষণ করা।

কীভাবে আইনের আশ্রয়

ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করাটা সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ। অধিদপ্তর অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ পেলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা প্রদানের আদেশ দেবে।

এই জরিমানা হিসেবে যে টাকা আদায় করা হবে তার ২৫ শতাংশ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও অবগত করতে পারেন।

সচেতন থাকতে হবে

অনলাইনে কোনো পণ্য কেনার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটি দরকার, তা হচ্ছে সচেতনতা। কোনো আকর্ষণীয় বা লোভনীয় বিজ্ঞাপন বা অফার দেখেই হুট করে কিনতে যাওয়া ঠিক নয়।

মতামত দিন