রোহিঙ্গাদের স্থানীয় সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান বাংলাদেশের

google news

রোহিঙ্গাবিশ্ব ব্যাংকের প্রস্তাবিত রূপরেখার সাথে বাংলাদেশের চিন্তাভাবনার কোন মিল নাই উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন- রোহিঙ্গারা শরণার্থী নয় বরং অল্প সময়ের জন্য আশ্রয় প্রার্থী, তাই বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশ সহ ১৬টি দেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে যাতে সংস্থাটি সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মূল স্রোতের সাথে তাঁদের একীভূত করার প্রস্তাব দিয়েছে।

সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে মোমেন জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিবেচনায় রোহিঙ্গারা ‘শরণার্থী’ না হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের বিষয়গুলো প্রযোজ্য নয়।

“আমরা যে রোহিঙ্গাদের রেখেছি, তারা আমাদের সংজ্ঞাতে শরণার্থী না। তারা হচ্ছে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত জনগণ, আমরা কিছুদিনের জন্য তাদেরকে এখানে আশ্রয় দিয়েছি। আমাদের অগ্রাধিকার ইস্যু হচ্ছে তারা ফিরে যাবে।

“আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারও বলেছে, তাদেরকে নিয়ে যাবে। চার বছর হলো যায় নাই, তারা কিন্তু কখনো বলে নাই, নিবে না। সুতরাং, এরা সাময়িকভাবে আশ্রয় নেওয়া লোক। এখানে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। তারা শরণার্থী না।”

এ নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক বলছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া দেশের ওপর প্রভাব কমিয়ে আনতে ওই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রস্তাবটি নির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য দেয়া হয়নি।

প্রস্তাবে বিশ্বব্যাপী শরণার্থী আশ্রয়দাতা সব দেশের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

সোমবার প্রস্তাবিত ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ বা শরণার্থী নীতি পর্যালোচনা কাঠামোর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানানোা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানতে চেয়েছে। এটি একটি বৈশ্বিক দলিল, যা কোনো দেশের জন্য নির্দিষ্ট নয়।’

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ নামের একটি পলিসি পেপারে রোহিঙ্গাদের এ দেশে স্থায়ীভাবে রেখে দেয়ার প্রস্তাব বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হয়।

বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাবের বিপক্ষে মতামতের জন্য ইআরডিতে চিঠিও দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সোমবারের বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, ‘প্রস্তাবিত রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কের লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশগুলোর প্রতি বিশ্বব্যাংকের সহায়তার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা, যাতে পরিস্থিতি সর্বোত্তমভাবে সামাল দেয়ার জন্য ওই দেশগুলো প্রয়োজনীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য দেয়া পর্যালোচনায় নীতি, অনুশীলন এবং বাস্তবায়ন সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে।’

কী আছে বিশ্বব্যাংকের রিফিউজি ফ্রেমওয়ার্কে

বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে পাঠানো ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’ নামের ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কাছ থেকে তারা কোনো মতামত না পেলে প্রস্তাবটি সরকার মেনে নিয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবটি রোহিঙ্গাসহ অন্য দেশে যেসব উদ্বাস্তু রয়েছে তাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য।

ফ্রেমওয়ার্কে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক ভিত্তিতে তৈরি ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি উদ্দেশ্য হলো উদ্বাস্তু ও হোস্ট কমিউনিটির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা, উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে ওই সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া অথবা তাদের ফেরত পাঠানো এবং দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে করে নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়া সম্ভব হয়।

বিশ্বব্যাংকের রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কের পক্ষে মত দিলে রোহিঙ্গারা দেশের ভেতরে যেকোনো স্থানে চলাচল করতে পারবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পারবে বা ব্যবসা করতে পারবে। পাশাপাশি তাদের নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান বাংলাদেশের

রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

সোমবার রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক ১৬টি দেশের শরণার্থীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের নিয়ে সুপারিশ করেছে যে, তাদের জন্মনিবন্ধন, চাকরির সুযোগ, জমি কেনা, নির্বাচন করার অধিকার মানে অনেকটা বাংলাদেশের নাগরিকদের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এটি হলে রোহিঙ্গাদের জন্য তারা বড় একটা ফান্ড দেবে। আমরা তাদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আমরা নিজ দেশে ফেরাতে চাই। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। তাই বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ আমরা রিভিউ করতে বলেছি।’

বিশ্বব্যাংকের এই সুপারিশ না মানলেও সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হবে না বলেও আশা করেন তিনি।

বাংলাদেশি নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদেরকেও তার সব সুবিধা দেয়ার আবদার জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটির প্রস্তাব, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে জমি কেনার সুযোগ দেয়া হোক, তাদের স্বাধীনভাবে যাতায়াত করতে দেয়া হোক, তাদের নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হোক।

বাংলাদেশ এই প্রস্তাব মানলে বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা জানিয়েছে তারা।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ছুটে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১০ লাখের বেশি। কারণ, আশির দশক থেকেই তারা দলে দলে আসছে বাংলাদেশে।

এতদিন কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হলেও সম্প্রতি নোয়াখালীর দ্বীপ ভাসানচরে আশ্রয় পরিকল্পনা করে এরই মধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করানো।

আরও …… 

মতামত দিন