একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে কাজুবাদামের বৈশ্বিক বাজারে বিলিয়ন ডলারের দখল নিতে কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ।
এ জন্য স্থানীয় প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির সক্ষমতা বাড়ানো, প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি কাজুবাদামের স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতেও কাজ করছে সরকার। খবর টিবিএস
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন খুবই কম থাকায় প্রাথমিক অবস্থায় ব্যপকহারে কাচা কাজুবাদাম আমদানি করে এনে প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পুনরায় রপ্তানি করা হবে বলে জানা গেছে।
এ বছরই রপ্তানি শুরুর প্রক্রিয়া চলছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়, কাজুবাদামের প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে উঠা কাজুবাদামের বাগান থেকে প্রায় দেড় হাজার টন ‘টাম বিচি’ (কাজুর গাছে উৎপাদিত ফল) উৎপাদন করা হচ্ছে।
যা থেকে প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে ২৬০-৩২০ মে. টন কাজুবাদাম পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রায় ৭০০ টন প্রক্রিয়াজাত করা কাজুবাদাম বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে।
দেশি প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে এখন শুধুমাত্র দেশে উৎপাদিত কাজুবাদামেরই প্রসেসিং করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদামের আমদানি গত চার বছরে প্রায় ৩২ গুণের বেশি বেড়েছে।
প্রসেসিং খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী কাজুবাদামের চাহিদা বাড়ছে সাড়ে চার শতাংশ হারে। সেখানে বাংলাদেশে ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
বর্তমান উৎপাদন পরিস্থিতি
কাজুবাদাম চাষের জন্য উপযুক্ত হলো পাহাড়ি অঞ্চল। এ ধারাবাহিকতায় বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ব্যাপকভাবে কাজুবাদামের চাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২০০০ এর বেশি মানুষ কাজুর বাগান করেছে।
বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলার কৃষক রেনিং ম্রো ৫ একর জমিতে কাজুর আবাদ করেছেন। সেখানে গাছ রয়েছে মোট ৩ হাজার, সবগুলোই গাছই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে দেয়া হয়েছে।
এই গাছ থেকে গত বছর ৯০ মণ টাম বিচি বিক্রি করেছেন। প্রতি মণ টাম বিচি ২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানান তিনি।
রেনিং ম্রো বলেন, “একবার বাগান করার পর খুব বেশি খরচ নেই। ফুল আসার পর শুধু বাগান পরিষ্কার করে দিতে হয়। এ কারণে কাজুতে প্রচুর লাভ”।
আরেক কৃষক নসরাং ত্রিপুরা সোয়া তিন একর জমিতে কাজুর বাগান করেছেন। তিনি গত ১৬ বছর ধরেই কাজুর বাগান করছেন। নিজেই ভালো মানের কাজুর বীজ সংগ্রহ করে কাজুর উচ্চ ফলনশীল জাত বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, একেকটি কাজুবাদামের গাছ ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। তিন বছর বয়সের পর থেকেই প্রতিটি গাছে ফলন আসে।
২০২৪ সালের মধ্যে কাজুর উৎপাদন দেড় হাজার টন থেকে ১০-১২ হাজার টনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যে অনুযায়ী কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করা হচ্ছে।
গত বছর ১ লাখ ৬৫ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে। চলতি বছরে ৩ লাখ চারা বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে।
কাজু বাদামের উৎপাদন ও জাত উন্নয়নে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কাজুর নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে।
প্রকল্পের আওতায় ৭ বিভাগের ১৯ জেলার ৬৬ উপজেলায় পার্বত্য বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এলাকাগুলোতে কাজবাদাম কফি চাষ সম্প্রসারণের কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এ তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত ৫ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি হিসেবে পড়ে রয়েছে।
এর মধ্যে ২ লাখ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম আবাদ করলে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করা সম্ভব, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, “আমাদের টার্গেট অন্তত দুই লাখ হেক্টর জমিতে কাজুর আবাদ করা।
এর জন্য বিনামূল্যে চারা বিতরণ, বাগান সম্প্রসারণে উৎসাহ দেয়া, নতুন নতুন জাত উন্নয়নের কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর”।
প্রসেসিং খাতের অবস্থা
কাজু বাদামের প্রসেসিং এর জন্য দেশে মোট ১২টি কারখানা স্থাপিত হয়েছে। যারা দেশে উৎপাদিত কাজু বাদামের প্রসেসিং করছে। প্রতি বছর প্রায় ৩০০ টন কাজু বাদাম প্রসেসিং করা হচ্ছে এই কারখানাগুলোতে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ম্যানুয়াল পদ্ধতির মেশিনারিজ দিয়ে তৈরি কারখানার খরচ কম হলেও অটোমেটেড মেশিনারিজ দিয়ে তৈরি কারখানাতে বেশ ভালো বিনিয়োগ করতে হয়।
ম্যানুয়াল পদ্ধতির একটি কারখানা ছোট পরিসরে শুরু করতে চাইলে প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।
অন্যদিকে অটোমেটেড মেশিনারিজ নিয়ে কারখানা করতে চাইলে সেখানে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি টাকা বিনিয়োগ লাগে প্রাথমিক পর্যায়ে।
প্রসেসিং এ সংশ্লিষ্টরা জানান, কাজুর প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে এখন পর্যন্ত দেশি কাচামালই ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আমদানিতে খরচ বেশি পড়ায় কাচামাল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
মোঃ ইবনুল আরিফুজ্জামান নীলফামারির উদ্যোক্তা এবং জ্যাকপট ক্যাশিওনাট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তিনি কারখানা শুরু করেছিলেন ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। বর্তমানে তার বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি টাকার বেশি। এই কারখানায় প্রতি মাসে ৭ টন প্রসেসড কাজু উৎপাদিত হচ্ছে।
এই উদ্যোক্তা টিবিএসকে বলেন, “দেশি কাজুবাদামের আকার কিছুটা ছোট। স্থানীয় বাজারে চাহিদা থাকলেওবিশ্ববাজারে এর চাহিদা কম।
এখন আমরা বিশ্ববাজার ধরতে চাইলে কাচা কাজু আমদানি করে প্রসেস করতে হবে। কিন্তু আমদানির খরচ বেশি হওয়ার কারণে আমদানি করে পোষাতে পারছি না”।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে সম্প্রতি কাজুর আমদানি শুল্ক ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। যাতে করে ইন্ডাস্ট্রিগুলো সহজে কাচামাল আমদানি করতে পারে।
কিন্তু উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ করা হলেও বর্তমানে কাচা কাজুবাদাম আনতে নানা ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে মোট মূল্যের ৩৭.৫ শতাংশ খরচ করতে হয়।
এই খরচে কাচামাল এনে বাজারজাত করা পর্যন্ত যে খরচ হয় তার চেয়ে যারা প্রক্রিয়াজাত করা কাজু বাদাম আমদানি করে তাদের খরচ কম পড়ছে।
মোঃ ইবনুল আরিফুজ্জামান বলেন, “আমাদের দাবি সরকার কাচামাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক তুলে দিক। ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়ানোর জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণ পাওয়া নিয়ে যেসব জটিলতা রয়েছে সেখানে সরকার সহযোগিতা না করলে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবে না”।
জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত কাচা কাজুবাদাম রপ্তানি শুরু হয়নি। শুল্ক জটিলতা নিয়ে উদ্যোক্তারা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছে। সরকার সহযোগিতার আশ্বাস দিলে তবেই কাচামাল আমদানি শুরু করবে এবং তা রপ্তানি করবে।
কাচামালের সংকটের চেয়েও বড় সমস্যা ব্যাংক ঋণ না পাওয়া বলে জানান উদ্যোক্তারা। অন্য একটি সমস্যা হলো কম দামে প্রসেসড কাজুর দেশে প্রবেশ।
এই সমস্যাগুলো দূর হলেই উদ্যোক্তারা এখানে বিনিয়োগ করবে এবং রপ্তানিতে সাফল্য আসবে।
‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, “প্রসেসিং খাতটা যেহেতু বেসরকারী পর্যায়ে গড়ে উঠছে।
তাদেরকে জন্য ব্যাংক লোন পাওয়া সহজ করা, কাচামাল আমদানি জটিলতা দূর করা নিয়ে সহযোগিতা করার জন্য আমরা কাজ করছি”।
কাজুবাদামের বিশ্ব বাজার
বর্তমানে কাজুবাদামের বৈশ্বিক উৎপাদন ৩৫ লাখ টনের বেশি। যেখানে ভারত এককভাবে উৎপাদন করছে সাড়ে সাত লাখ টন।
ভিয়েতনাম করছে ৪ লাখ টন। অন্যদিকে আফ্রিকার ৪-৫টি দেশে মোট ১২ লাখ টন কাজুবাদাম উৎপাদিত হচ্ছে।
সারা বিশ্বে কাজুবাদামের ৯.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম একাই সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার কাজুবাদাম রপ্তানি করছে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর সাড়ে ৪ শতাংশ হারে কাজুবাদামের বাজার বাড়ছে বলে জানান খাত সংশ্লিষ্টরা।
রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় প্রথম সারির তিনটি দেশ হলো ভিয়েতনাম, ভারত ও নেদারল্যান্ড।
এছাড়া জার্মানি, ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আইভরি কোস্ট, ইন্দোনেশিয়া, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কজুবাদাম রপ্তানি করছে।
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জসমূহ
পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো- বিদ্যমান জাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে চাষিদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল, সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে চাষিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান; বিদ্যমান বাগানসমূহের জাত উন্নয়ন, উত্তম কৃষি চর্চা (গ্যাপ) নীতিমালা অনুসরণ করে মানসম্মত কাজুবাদাম উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি, নিজস্ব উৎপাদনের সাথে সাথে অন্যান্য দেশ হতে কাচা কাজুবাদাম আমদানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “কৃষিকে লাভজনক করতে হলে কাজুবাদাম, কফি, গোলমরিচসহ অপ্রচলিত অর্থকরী ফসল চাষ করতে হবে।
শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও এসবের বিশাল চাহিদা, দামও বেশি। সেজন্য এসব ফসলের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাত বাড়াতে হবে”।
তিনি বলেন, “পাহাড়ের বৃহৎ অঞ্চলজুড়ে এসব ফসল চাষের সম্ভাবনা অনেক। আমরা কাজুবাদাম উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নয়ত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিচ্ছি।
এটি করতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটবে”।
এসময় মন্ত্রী আরও বলেন, “প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ আকর্ষক করতে যে ধরনের সুবিধা দেওয়া দরকার তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। কারণ আমাদের সর্বশেষ টার্গেট রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন”।