বাংলাদেশের কাছে ফোন-হ্যাক করার উপকরণ বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেলেব্রাইট৷ ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র গনমাধ্যমের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন৷
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হতে দেশটির সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)-কে বেশ কিছু তথ্য প্রদান করেছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান সেলেব্রাইট৷
এসইসি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সেসব তথ্যের মাঝে সেলেব্রাইট লিখেছে, ‘‘আমরা বাংলাদেশ, বেলারুশ, চীন, হংকং, ম্যাকাও, রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যার আংশিক কারণ হচ্ছে দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সেখানে তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে৷”
গত ১৭ মে এসইসি ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশিত হলেও সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রভাবশালী হারেৎস পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে বিষয়টি অনেকের নজরে আসে৷
হারেৎস লিখেছে, ‘‘সেলেব্রাইট বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ‘ডিজিটাল ফরেনসিক’ সমাধান বিক্রি করে৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পণ্যের নাম হচ্ছে ‘ইউনিভার্সেল ফরেনসিক এক্সট্রাকশন’ ডিভাইস।
এই ডিভাইস ব্যবহার করে ‘লকড’ থাকা মোবাইল ফোনের বিভিন্ন তথ্য এবং সেটির অবস্থান ফোনটির মালিকের অনুমতি ছাড়াই সংগ্রহ করা যায়৷”
পত্রিকাটি আরো লিখেছে, ‘‘সেলেব্রাইটের মূল খদ্দের পশ্চিমা বিভিন্ন পুলিশ বাহিনী হলেও এটি অন্যত্রও এই ডিভাইস বিক্রি করে, যার মধ্যে এখনো পর্যন্ত অন্তত বাংলাদেশও রয়েছে।”
সেলেব্রাইট-এর মুখপাত্র জো ওয়ালটন বাংলাদেশের সঙ্গে আর ব্যবসা না করার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সেলেব্রাইটের ওয়েবসাইটেও এই তথ্য রয়েছে৷
ইংরেজিতে প্রকাশিত হারিজের প্রতিবেদনটির হুবহু বাংলা অনুবাদ দেয়া হলোঃ
সেলেব্রাইট বিশ্বজুড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে “ডিজিটাল ফরেনসিক” সলিউশান দিয়ে থাকে। ইউনিভার্সাল ফরেনসিক এক্সট্রাকশন ডিভাইস হলো সেলেব্রাইটের প্রধান পণ্য।
এটি মালিকের সম্মতি ছাড়াই লক করা মোবাইল ফোন এবং তাদের ফিজিকাল পজিশন থেকে ডেটা নিয়ে নিতে সক্ষম।
সেলেব্রাইটের প্রধান গ্রাহক হল পশ্চিমা পুলিশ বাহিনী, কিন্তু এটি তার পণ্য অন্যত্রও বিক্রি করে থাকে- অন্তত এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এ তালিকায় রয়েছে।
মার্চ মাসে, মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ইতাই ম্যাকের ইসরাইলের সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা নথি থেকে বেরিয়ে আসে, সেলেব্রাইটের বাংলাদেশী একটি ইউনিটের সাথে লেনদেন হয়েছিল।
যাকে মানবাধিকার সংগঠনটগুলো “ডেথ স্কোয়াড” বলে অভিহিত করেছে এবং এর বিরুদ্ধে মুসলিম দেশটিতে ‘এলজিবিটিকিউ’দের নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০১৮ সালে এই ইউনিট ৪৬৬ টি বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী ছিল।
ম্যাকের আবেদনের অংশ হিসেবে ওই নথিগুলো জমা দেওয়া হয়েছিল যাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে কারণ ব্যাখ্যা করতে বলে যে কেন সে সেলেব্রাইটকে তার পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করতে দিচ্ছে।
ম্যাকের নথি অনুসারে, সেলেব্রাইট সিঙ্গাপুর ভিত্তিক একটি কোম্পানিকে বাংলাদেশের সাথে তার লেনদেনের জন্য ‘প্রক্সি’ হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
বাংলাদেশের ইসরাইলের সাথে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ইসরাইলি সংস্থাগুলোর সাথে সে সরাসরি ব্যবসা করতে পারে না।
বাংলাদেশের ওই সংস্থার কর্মকর্তাদেরও ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে সেলেব্রাইট সিস্টেমের প্রশিক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছিল।
হারিই জানতে পেরেছে যে কোম্পানিটি ২০২১ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে বিক্রয় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও তাদের এই সিদ্ধান্তটি মে মাসে প্রকাশ করা হয়, যখন সেলেব্রাইট ‘এসইসি’কে তার কার্যক্রমের হালনাগাদ করা রূপরেখা পাঠিয়েছিল এবং তার সম্পূর্ণ কালো তালিকা প্রকাশ করে যে এটি কোন দেশের সঙ্গে ব্যবসা করবে না।
আগস্টে, কোম্পানিটি এসইসিকে একটি এথিকস কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছিল।
উভয় সিদ্ধান্তই সম্ভবত সেলেব্রাইটের এই বছর ‘পাবলিকলি’ যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই নেয়া হয়েছিল।
এটি এমন এক প্রক্রিয়া যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নয় এমন কোম্পানিকে এসইসির কাছে তার সম্পূর্ণ কার্যকলাপ প্রকাশ করতে হয়।
সেলেব্রাইট তার এসইসি ফাইলিংয়ে বলেছে, “যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য বা ইসরাইলি সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলোতে বা যারা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) কালো তালিকাভুক্ত, সেসব দেশগুলোতে সে পণ্য বিক্রি করে না।”
“আমরা কেবল সেসব গ্রাহকদেরই অনুসরণ করি যাদের আমরা বিশ্বাস করি যে তারা আইনগতভাবে কাজ করবে এবং যারা গোপনীয়তার অধিকার বা মানবাধিকারের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা মানবাধিকার এবং ডেটা সুরক্ষা সম্পর্কিত উদ্বেগের কারণে আংশিকভাবে বাংলাদেশ, বেলারুশ, চীন, হংকং, ম্যাকাও, রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলায় ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং ভবিষ্যতে আমরা অনুরূপ কারণে অন্যান্য সম্ভাব্য দেশ বা গ্রাহকদের সাথেও কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি”, নথিতে বলা হয়েছে।
সেলেব্রাইট দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে এটি শুধু বৈধ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পণ্য বিক্রি করে এবং ইসরাইলের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি এটি তার নিজস্ব কঠোর ‘নৈতিক সম্মতি’ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে।
সংস্থাটি বলে যে এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত দেশসমূহের কাছে বিক্রি করতে অনেকবার অস্বীকার করেছে।
যাই হোক, সমালোচকরা দীর্ঘদিন ধরে ইন্দোনেশিয়া থেকে ভেনেজুয়েলা, সৌদি আরব এবং বেলারুশ পর্যন্ত মানবাধিকারের দিক থেকে খারাপ দেশের কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য কোম্পানিটির নিন্দা করে আসছেন।
বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে, এই ধরনের দেশগুলিতে বিক্রয় বন্ধ হয়ে গেছে কেবল তখনই, যখন সেসব ঘটনা মিডিয়া দ্বারা বা আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে যা সেলেব্রাইটের ক্লায়েন্টদের মানবাধিকার রেকর্ড পর্যালোচনার দাবিটিকে সন্দেহজনক করে তুলে।
এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায়, সেলেব্রাইটের একজন প্রতিনিধি হারিজকে বলেন যে কোম্পানি “তার মূল মূল্যবোধ এবং কাজের অনুশীলনের অংশ হিসেবে নৈতিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং একটি খুব শক্তিশালী ‘সম্মতি কাঠামো’ তৈরি করেছে।
সেলেব্রাইটের কঠোর লাইসেন্সিং নীতি এবং বিধিনিষেধ রয়েছে যা নিয়ন্ত্রণ করে যে গ্রাহকরা কীভাবে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে।
আমাদের বিক্রয় সিদ্ধান্তগুলো অভ্যন্তরীণ “প্যারামিটার’ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা সম্ভাব্য গ্রাহকের মানবাধিকার রেকর্ড এবং দুর্নীতি বিরোধী নীতিগুলো বিবেচনা করে।”
সেলেব্রাইট-ই একমাত্র ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান নয় যেটি বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা করে।
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত আল জাজিরার তদন্তে, বাংলাদেশের কাছে ইসরাইলি সাইবার-নজরদারি সংস্থা পিক্সিক্সের তৈরি ‘প্যাসিভ’ সেল ফোন মনিটরিং এবং ‘ইন্টারসেপশন’ সিস্টেম বিক্রির নথিপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায় যে কোম্পানিটি ইসরাইলে নিবন্ধিত হলেও, বিক্রয়কারী হিসেবে মূল দেশ ছিল হাঙ্গেরি।
ইসরাইলি প্রযুক্তির অপব্যবহার সম্প্রতি এনএসও গ্রুপ এবং এর পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে বিশ্বব্যাপী তদন্তের অংশ হিসেবে শিরোনাম হয়েছে।
‘দ্য প্রজেক্ট পেগাসাস’ তদন্তে জানা গেছে যে বিশ্বজুড়ে ১৮০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে এনএসও -এর ক্লায়েন্টরা সম্ভাব্য লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে।
ফরবিডেন স্টোরিজ নামে একটি অলাভজনক সংগঠনের নেতৃত্বে এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া ১৫ টিরও বেশি সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে হারিজ – এটি প্রকাশ করতে সাহায্য করেছিল যে কীভাবে আক্রমণাত্মক ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার বিক্রি মুসলিম রাষ্ট্রসহ শত্রু দেশগুলোর কাছে ইসরাইলকে পৌঁছতে ভূমিকা রেখেছিল।
সম্ভাব্য টার্গেটদের মধ্যে বাংলাদেশী নাম্বার পাওয়ার পর তদন্তে বাংলাদেশের নামও ছিল। তবে, এটি স্পষ্ট নয় যে, ক্লায়েন্ট কে ছিল এবং এনএসও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সাথে ব্যবসা করেছিল কিনা।