মহামারি করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক সংকটে পড়া প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় দেশটিকে প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে ৫ কোটি ডলার ছাড় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪২৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা)।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এই ডলার দেয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কাকে দেয়া এ অর্থ ছাড়ের মাধ্যমে প্রথম কোনো দেশকে ঋণ দিলো বাংলাদেশ।
এছাড়া এর মাধ্যমে ঋণদাতা দেশের তালিকায় নাম লেখালো বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক যুগে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রপ্তানিতে ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীত হওয়ায় ঋণ দেয়ার এই সক্ষমতা অর্জন করলো বাংলাদেশ।
এই বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর শ্রীলঙ্কাকে দেয়া হবে মোট ২৫ কোটি ডলার। ৫ কিস্তিতে এই অর্থ ছাড় করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এ অর্থ দেয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার অনুকূলে অর্থ ছাড়ের পর বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৪৬.৫৮ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৬৫৮ কোটি ডলার।
গত মে মাসে মুদ্রা বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) আওতায় শ্রীলংকাকে এই ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, শ্রীলঙ্কার চাহিদার ভিত্তিতে প্রথম দফায় ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। প্রতিশ্রুত ঋণের বাকি অংশ দেশটির চাহিদা বিবেচনায় ছাড় করা হবে।
সূত্র জানায়, মুজিব চিরন্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে গত ১৯শে মার্চ ঢাকায় আসেন।
ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে।
সেই বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ডব্লিউ ডি লক্ষ্মণ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে ডলার চেয়ে সম্প্রতি চিঠি দেন।
শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপেক্ষিতে গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তাদের ঋণ দেয়ার নীতিগত অনুমোদন হয়।
জানা গেছে, দেশের মধ্যেও এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের সঙ্গে সোয়াপ করে।
সাধারণভাবে টাকা ও ডলারের সোয়াপ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার সাময়িক সংকটে পড়লে টাকা রেখে স্বল্প সময়ের জন্য ডলার নেয়।
ওই ব্যাংকের হাতে ডলার এলে নির্ধারিত সুদসহ আবার তা পরিশোধ করতে হয়। তখন জমা টাকা ফেরত পায় ব্যাংকটি।
যেসব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কম তারা বিপদে পড়লে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। তবে শ্রীলঙ্কার এই মুহূর্তে সেটি নেই।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এভাবে ডলার দিচ্ছে। যে পরিমাণ ডলার বাংলাদেশ দেবে সেটা রিজার্ভ থেকে কমে যাবে।
এতে বাংলাদেশের সুনাম হবে। তবে কোনো কোনো সময় এ ধরনের টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হয়, তখন একটু অসুবিধা হয়।
কারেন্সি সোয়াপ বা আন্তঃদেশীয় মুদ্রা বিনিময় অনেকটা ‘ব্যাংক টু ব্যাংক লেন্ডিং’এর মতো হওয়ায় ঝুঁকি কম বলে জানান আহসান মনসুর।
তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কা যদি এই টাকা দিতে না পারে, তখন বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে যে বৈদেশিক বাণিজ্য হয়, সেখানে দেনা-পাওনা থেকে এই টাকা সমন্বয় করে নেযা যাবে।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নে (ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ) চাহিদার তুলনায় অনেক ঘাটতিতে রয়েছে শ্রীলংকা।
দেশটির জিডিপির আকার ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। কিন্তু বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ৪০০ কোটি ডলারের ঘরে, যা জিডিপির ৪.৭৬ শতাংশ।
যেখানে বাংলাদেশে এ সঞ্চয়ন জিডিপির ১৩.১৫ শতাংশ।
সমঝোতা অনুযায়ী এই ধারের জন্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে লাইবরের (লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হার) সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ সুদ যুক্ত করে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করবে।
তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য দিতে হবে লাইবরের সঙ্গে অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ সুদ। লাইবর হলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার রেট। বর্তমানে লাইবর রেট ২ শতাংশের কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিয়োগের বিপরীতে গ্যারান্টি দেবে শ্রীলঙ্কার সরকার ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ২৫ কোটি ডলার সমমূল্যের শ্রীলঙ্কান রুপি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লিয়েন হিসেবে জমা থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করবে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা।
শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-সংকটে ভুগছে। বর্তমানে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি ডলার।
এ রিজার্ভ দিয়ে তাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। রিজার্ভকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রাখতে হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ২০০১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়লে দেশের রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। তখন বাংলাদেশ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে।
তখন আকুর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রথম সোয়াপ করে। আকুর সদস্যদেশগুলো বাকিতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালায়। প্রতি দুই মাস পরপর দেনা-পাওনা সমন্বয় করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে কমপক্ষে ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৩৬ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের রিজার্ভ। আর পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার। নেপালের রিজার্ভ উন্নীত হয়েছিল ১১ বিলিয়ন ডলারে।
শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০১৮ সালের এপ্রিলে। সে সময় দেশটির রিজার্ভ ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। তবে করোনাকালে সেটি প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।